শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা : রাজার অনুষ্ঠান বলে কথা! সবকিছুই সেখানে রাজকীয়। এমনকি দুটি পাতা একটি কুঁড়ির মৌতাতও। আর তাই ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলার শনিবারের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে ঠাঁই করে নিল দার্জিলিং পাহাড়ের মকাইবাড়ির স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় ফার্স্ট ফ্লাশের স্পেশাল করোনেশন চা।
ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছ থেকে বরাত পেয়ে তৈরি বিশেষ ব্লেন্ডের মোট ৫০০ টিন চা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল বাকিংহাম প্যালেসে। যা এদিন মন জয় করেছে সকলের। নেপথ্যে থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শরিক হতে পেরে গর্বিত কার্সিয়াংয়ের বিখ্যাত বাগানটি।
মকাইবাড়ির ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুদ্র চ্যাটার্জি বলছেন, রাজার রাজ্যাভিষেকের জন্য যে চা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে সেটার ব্লেন্ড একটু আলাদা। তৈরির পদ্ধতিতে আমাদের অন্য চায়ের সঙ্গে এই চায়ের অবশ্য খুব একটা ফারাক নেই। তবে, ইতিহাসের অঙ্গ হতে পেরে ভালো লাগছে।
রাজ্যাভিষেকের চা কি শুধু বাকিংহাম প্যালেসের চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমিত থাকবে? এক্ষেত্রেও অবশ্য একটু অন্য পথে হেঁটেছে মকাইবাড়ি। এরাজ্যের চা প্রেমীদের জন্যও করোনেশন ব্লেন্ডের বিশেষ এডিশনের ওই চা অতিরিক্ত ১ হাজার টিন তৈরি করা হয়েছে, যা চলতি মাসের মধ্যেই এখানে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন রুদ্র।
রাজা চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ বা সংক্ষেপে তৃতীয় চার্লস গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর মা দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনে বসেন। তবে প্রথা মেনে রাজ্যাভিষেক বা করোনেশনের অনুষ্ঠান ছিল শনিবার। তাতে বিশ্বের নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের পাশাপাশি ভারত থেকে যোগ দিয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকরও। মকাইবাড়ির চা-ও যেন প্রতীকী অর্থে ছিল ওই অনুষ্ঠানে দেশের প্রতিনিধিত্বকারীই।
গত বসন্তে তৈরি মকাইবাড়ির যে ৫০০ টিন জৈব চা রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানের জন্য পাঠানো হয়েছে তাতে টিন প্রতি রয়েছে ১০০ গ্রাম করে। তৃতীয় চার্লস চিনি নয়, মধু দিয়ে চা খান। সেটা মাথায় রেখেই তৈরির সময় ব্লেন্ডে কিছুটা বদল করা হয়েছে।
মকাইবাড়ির প্রতি বাকিংহাম প্যালেসের আকর্ষণ অবশ্য নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০১৭ সালে তৃতীয় চার্লস বাগান কর্তৃপক্ষকে নিজের হাতে লেখা একটি চিঠি পাঠান। তাতে তিনি বাগানটি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। সেসময় অবশ্য চার্লস ছিলেন ওয়েলসের যুবরাজ। তথ্য বলছে, ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বাকিংহাম প্যালেসে রানি এলিজাবেথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সেসময় তিনি তাঁর হাতে মকাইবাড়ি বাগানেরই তৈরি চা ও সঙ্গে কাশ্মীরের মধু উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন। যা টুইট করে সেসময় মোদি জানিয়েছিলেন।
গোড়াপত্তনের সময় থেকেই নিখাদ বাঙালি শিল্পপতিদের পরিচালিত মকাইবাড়ির চা কাপে তুফান তুলতে হাজির থেকেছে একাধিক বিশ্বজনীন ইভেন্টে। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্স কিংবা ২০১৪-য় ব্রাজিলে আয়োজিত ফুটবল বিশ্বকাপের অফিশিয়াল পানীয় হিসেবে ১৬৪ বছরের ঐতিহ্যশালী বাগানটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির সম্মেলনও হয়েছে সেখানে।
ব্রিটিশদের হাত দিয়ে পাহাড়ে চা বাগান গড়ে উঠলেও মকাইবাড়ি বরাবরই স্বাধীন ছিল স্বদেশি শিল্পপতিদের হাত ধরে। ৭০ বছর পরে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা পেল গ্রেট ব্রিটেন। সেই দেশেরই এক সময়ে উপনিবেশ ভারতের মকাইবাড়ির শিরা-ধমনীতে স্বাধীনতার রক্ত যে সমানতালেই প্রবাহিত তা করোনেশনের চা এখানকার জন্যও রেখে দেওয়াতেই হয়তো বা ফের প্রমাণিত।
ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতন ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে একে!