- শুভাশিস মৈত্র
প্রায় নিয়ম করে বছরে অন্তত তিন থেকে চারবার সংবাদমাধ্যমে খবর দেখা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতার লড়াই নিয়ে। কিছু দিন চলে। দলের নানা নেতা তাঁদের মাপ আনুযায়ী নানা বিবৃতি দেন। তারপর আবার সব থিতিয়ে যায়। এবারের দ্বন্দ্বের বিষয় সরকারবিরোধী শিল্পীদের ‘বয়কট’।
আরজি কর সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় মহিলা ডাক্তারের খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় যাঁরা রাস্তায় নেমে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন করেছেন, পদত্যাগ দাবি করেছেন, তাঁদের নিয়ে বিতর্ক শুরু তৃণমূলের অন্দরে। এমন শিল্পীদের কত ধানে কত চাল, সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার একটা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে শাসকশিবিরে। বেশ গলা ফাটিয়েই বলা হচ্ছে, এই শিল্পীরা কোথাও অনুষ্ঠান করতে গেলে বাধা দেওয়ার কথা। বোঝা যাচ্ছে, এরপর কেউ তাঁদের অনুষ্ঠানে ডাকতেও সাহস পাবে না। আসলে ক্ষমতা চাইছে, প্রতিবাদী শিল্পীরা নতজানু হন।
দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান অবশ্য এ ব্যাপারে ঠিক উলটো। তিনি বলেছেন, এই কাজ ঠিক নয়, এটা দলের সিদ্ধান্ত নয়। যদিও তার পরেও দেখা গেল, দলের এক সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, যতক্ষণ না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বারণ করছেন, তিনি এই বাধা দানের পক্ষেই সওয়াল করে যাবেন। ইঙ্গিত এটাই যে এই কাজে মমতার সায় আছে।
এক সাংসদ বলেছেন, তাঁর নির্বাচনি ক্ষেত্রে এমন শিল্পীদের অনুষ্ঠান হলে তিনি বাধা দেবেন। এক মন্ত্রী বলেছেন, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে ফের চর্চায় পিসি-ভাইপোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এবারের লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য অন্য জায়গায়। দলের যে নেতারা অভিষেকের ঘনিষ্ঠ বলে এতদিন পরিচিত ছিলেন, তাঁদের অনেককেই দেখা যাচ্ছে অভিষেকের মতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে।
অভিষেকের প্রভাব কি তা হলে পার্টিতে কমছে? এক মাস আগেই দলের এক বিধায়ক দাবি জানিয়েছিলেন অভিষেককে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব দিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী করার। কুণাল ঘোষ এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছিলেন, ‘সময়ের নিয়মে মমতাদির পর একদিন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবেন অভিষেক… মমতাদি’র নেতৃত্ব চলতে থাকুক, তার মধ্যেই আগামীর পদধ্বনি হতে থাকুক।’ এসব চলতে চলতেই গত ২ ডিসেম্বর বিধানসভায় পরিষদীয় দলের বৈঠকে মমতা সব নেতাকে ডেকে বলে দিলেন, ‘অনেক নেতা-মন্ত্রীর মধ্যে যেমন খুশি সাজো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাঁদের আলটপকা কথায় বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। মেপে কথা বলুন, বেচাল দেখলে দল ব্যবস্থা নেবে।’ বৈঠকে তিনি মন্তব্য করেন, তিনিই দলের চেয়ারপার্সন, দলে তাঁর কথাই শেষ কথা।
মমতার এই বার্তায় কাজ হল ম্যাজিকের মতো। আনুগত্য প্রকাশের প্রতিযোগিতায়, শিল্পী-বয়কট নিয়ে কয়েকজন নেতা, যাঁরা এতদিন অভিষেকপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদেরও দেখা গেল অভিষেক বিরোধী অবস্থান নিতে। ফলে এই মুহূর্তে এমন মনে হওয়ার কারণ রয়েছে, দলে অভিষেকের গুরুত্ব কমেছে। বলা যায়, অভিষেক ডায়মন্ড হারবারের ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হয়ে থাকতে পারবেন, কিন্তু রাজ্যের নিরিখে তাঁর ঢালতরোয়াল আপাতত অকেজো। যদিও অভিষেকের এই আপাত-নিষ্প্রভ দশা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। সম্ভবত খুব বেশিদিন নয়। কারণ কোনও সন্দেহ নেই, শেষপর্যন্ত এটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ঘরোয়া ব্যাপার।
অভিষেক কিন্তু ঠিক পরামর্শই দিয়েছেন দলকে। শিল্পীদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ ঘোষণার ফল ভালো নাও হতে পারে।
এমনিতে স্পষ্ট, তৃণমূল কংগ্রেস কোনও আইডিওলজি নির্ভর দল নয়। প্রধানত মমতার ক্যারিশমা এবং সংগঠন, একই সঙ্গে প্রশাসন-পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, এর উপর নির্ভর করেই তৃণমূল অর্জন করেছে একের পর এক বিরাট জয়। কিন্তু একটা দল শুধু এই দিয়েই বারবার ভোটে জেতে না। তার একটা ‘কালচারাল ন্যারেটিভ’-ও দরকার হয়। তৃণমূল কংগ্রেস নতুন কোনও ‘কালচারাল ন্যারেটিভ’-এর জন্ম দেয়নি। এই বিষয়ে তাঁরা বামপন্থী ‘লিগ্যাসি’-কেই বহন করে চলেছে। এই কারণেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কবীর সুমন, নচিকেতা, বিভাস চক্রবর্তীর মতো বাম ঘরানার বহু বিশিষ্ট শিল্পী মমতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘর করতে পারেন। প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবীর কথাও মনে রাখা উচিত। তৃণমূলের সভা-সমিতিতে তাই নিয়মিত শোনা যায় ‘উই শ্যাল ওভার কাম’, ‘কারার ওই লৌহকপাট’ বা ‘থাকিলে ডোবা খানা’-র মতো গান। যেসব গান একদা বামপন্থীদের সভাতেই গাওয়া হত।
বামপন্থীদের যাঁরা ভোট দিতেন এমন বহু ভোটারের ভোট পায় বলেই টানা তিনবার ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁদের অনেকেই শিল্পী বয়কটের এই ফ্যাসিস্টসুলভ রাজনীতি ভালো চোখে না-ও দেখতে পারেন। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানের সমর্থক অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালিও এটাকে ভালোভাবে নেবে না। তাঁদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তৃণমূলের অসহিষ্ণুতা নির্ভর এই বয়কট কর্মসূচি সফল হলে এমনকি আঘাত লাগতে পারে মমতার সর্বভারতীয় ভাবমূর্তিতেও।
আরজি করের ঘটনায় মধ্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রতিবাদের চাপে মমতা, বলা যায় গত ১৩ বছরে প্রথমবার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। বদলি করতে হয়েছে একাধিক শীর্ষ পদের অফিসারকে। তারপর রাজ্যে হয়ে গিয়েছে ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচন। সবক’টি আসনে তৃণমূল জয়ী হয়েছে। তৃণমূল ভাবছে এই জয় তাদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খারিজ হয়ে যাওয়ার শংসাপত্র। এবার শিল্পীদের বয়কটের আওয়াজ তুলে তৃণমূল সম্ভবত বদলা নিতে চায় আরজি করের।
কিন্তু ভোটে জেতা মানে চার্জশিট থেকে সব অভিযোগ মুছে গেল, এই ভাবনাটা ভুল। উপনির্বাচনে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি খুব ভালো ফল করেছে উত্তরপ্রদেশে। তার মানে এই নয়, যে যোগীর বুলডোজার জাস্টিস সঠিক পদ্ধতি ছিল, তাঁর বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে স্লোগান অসাম্প্রদায়িক ছিল।
গত সপ্তাহে মমতা গিয়েছিলেন সন্দেশখালিতে। সেখানে লোকসভা, বিধানসভা দুটি আসনই তৃণমূল জিতেছে। এটা ঠিক, সন্দেশখালি নিয়ে বিজেপির কিছু সাজানো অভিযোগ ছিল। তা নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে যা করণীয় মমতার তা অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু এটাও তো ঠিক, মমতা তাঁর দলের যে নেতাদের সন্দেশখালি পাঠিয়েছিলেন ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে, তাঁদের প্রায় সবাই সন্দেশখালি থেকে ফিরে সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বীকার করেছিলেন স্থানীয় নেতাদের বিভিন্ন অন্যায়ের কথা, গরিব মানুষের জমি কেড়ে নেওয়ার কথা।
মমতা গত সপ্তাহে সন্দেশখালিতে গিয়ে বলেছেন সেখানকার মানুষ যেন দুষ্টু লোকেদের থেকে সতর্ক থাকেন। মানুষের সতর্ক থাকার ব্যাপারটা তো পরের কথা, আগে তো দরকার ওই সব দুষ্টু লোকেদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা। গ্রেপ্তার করবে পুলিশ। যে দপ্তরটা তাঁরই হাতে।
ফিরে আসা যাক শিল্পী বয়কটের প্রসঙ্গে। তৃণমূল কংগ্রেসের অনেকেই হয়তো ভুলে গিয়েছেন, ৭০-এর দশকের গোড়ায় সিদ্ধার্থশংকর রায়ের জমানায় উৎপল দত্তের ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটকের ওপর হামলার কথা। সেই দল কিন্তু ৪৭ বছরেও আর ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গে। হামলা হয়েছিল ব্রাত্য বসুর ‘উইঙ্কল-টুইঙ্কল’-এ ২০০২-এ। সেই বামেরা এখনও শূন্য। ইতিহাসের এই শিক্ষা সব রাজনৈতিক দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
(লেখক সাংবাদিক)