মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

সাহিত্যের উত্তরণে বিপণনও জরুরি

শেষ আপডেট:

 

  • অভিষেক ঝা

মোটামুটি পরিচিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারগুলি ঘোষণার সময় বাংলা ভাষার সাহিত্যের বাজারজুড়ে বাৎসরিক একটি দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায়। এমনটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই রাষ্ট্রের বাংলা ভাষার সাহিত্য বাজারেই লক্ষ করা যায়। মোটামুটিভাবে বাংলা ভাষার লেখক ও প্রকাশকরা প্রতি বছর একমত হন যে, অনুবাদ ঠিকমতো হলেই আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কার আসবে ঝুড়ি ঝুড়ি না হলেও, অন্তত এক ব্যাগ। প্রতি বছর রুটিন মাফিক এই চর্চা চলতে থাকে। এবং চর্চা চলতে চলতেই আরেকটি দীর্ঘশ্বাসের সময় এসে পড়ে।

একদম পরিসংখ্যানগতভাবে দেখলে শেষ চার-পাঁচ বছরে বাংলা ভাষার সাহিত্যের জাতীয় ও আন্তজার্তিক পরিসরে উপস্থিতি নেহাত ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অমর মিত্রের গল্প ‘গাঁওবুড়ো’ ২০২২ সালে ও’হেনরী পুরস্কার পেয়েছে। সানিয়া রুশদির ‘হাসপাতাল’ উপন্যাসটি ২০২৪ সালে স্টেলা পুরস্কার, মাইলস ফ্র্যাঙ্কলিন সাহিত্য পুরস্কার, ভস সাহিত্য পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল।  সাগুফতা শারমিন তানিয়ার লেখা গল্প ২০২১ সালের বিবিসি ছোটগল্প পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকায়, ২০২২ সালের কমনওয়েলথ ছোটগল্প পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায়, ২০২২ সালের পেজ টার্নার পুরস্কারের অন্তিম তালিকায় স্থান পেয়েছিল। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে বেশি অর্থমূল্যের সাহিত্য পুরস্কার জেসিবি পুরস্কারের ক্ষেত্রে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর বই দুইবার সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য সংক্ষিপ্ত তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন একবার এবং ইসমাইল দরবেশ দীর্ঘ তালিকাভুক্ত হয়েছেন একবার। সুতরাং যতটা নিরাশার ছবি প্রচার করা হয়, এই সমস্ত উদাহরণ দেখলে মনে হয় পরিস্থিতি বোধহয় ততটাও হতাশাজনক নয়। আসলে  হতাশাজনক ব্যাপারটি লুকিয়ে রয়েছে অন্যত্র এবং তার কারণেই সার্বিকভাবে বাংলা ভাষার সাহিত্যের আন্তর্জাতিক বাজারের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে না।

যে সমস্ত সাফল্যের কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো প্রতিটিই লেখক, অনুবাদক এবং অনুবাদকের সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যক্তিগত চেনাজানার ভিত্তিতেই এসেছে। সাহিত্য পুরস্কার জগতের বাজারের সূত্র মেনে বাজারজাতকরণের যে প্রচলিত ধারা রয়েছে সেগুলির সুবিধা কিন্তু এই বইগুলি পায়নি। এই সাফল্যগুলি তাই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত সাফল্য হিসাবেই আমরা দেখব। আর ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন সাফল্য কখনোই একটি নিয়মিত ব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে না। এইজন্যই নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা ভাষার সাহিত্যের উপস্থিতি বজায়ও থাকে না। একটি ধারাবাহিক নিয়মিত ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি হল আগ্রাসীভাবে বাজারমুখী হওয়া। মুশকিল হল বাজারমুখী শব্দটি শুনলেই বাংলা ভাষা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। অপেক্ষাকৃত সরল মানুষজন বাজারমুখী হওয়ার সঙ্গে জনপ্রিয়তাকে অবিচ্ছেদ্য ভেবে দুটি পরিসরকে গুলিয়ে ফেলেন এবং অপেক্ষাকৃত নার্সিসিস্ট মানুষজন বাজারমুখী হওয়ার সঙ্গে অগভীর হওয়াকে অভিন্ন দেখিয়ে দুটি পরিসরকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই দুটি প্রতিক্রিয়াই আসলে একই মানসিকতার এইপাশ আর ওইপাশ।

প্রথম ধরনের মানসিকতার লোকজন আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বাজার সম্পর্কে প্রায় কোনও ধারণা না থাকায় সেইটাকে একমাত্রিক একটি জায়গা ভাবেন। দ্বিতীয় ধরনের মানসিকতার মানুষেরা আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে খানিক ধ্যানধারণা রাখায় বাজারজাত হওয়ার পর বাজারের নিয়মে বাতিল হওয়ার একটি আশঙ্কায় ভুগতে থাকেন। দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয় ওঠে।  বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাকারীদের আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কিংবা, সুস্পষ্ট ধারণা কখনোই দিতে চায়নি বাংলা ভাষার সাহিত্যের বাজার ব্যবস্থাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষজন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারকে অহেতুক মহিমান্বিত করা কিংবা অকারণে হেয় করার ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারবিমুখ হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষার সাহিত্য। প্রতিক্রিয়া হিসেবে একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারও বিমুখ হয়েছে বাংলা ভাষার সাহিত্যের প্রতি।

 আজকের দুনিয়ায় অ-ইউরোপীয়, অ-চৈনিক এবং অ-আরবীয় ভাষার লেখকদের আন্তর্জাতিক বাজারজাত করা আগের শতাব্দীর চেয়েও একটু কঠিন হয়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর দুনিয়ায় সাহিত্যে ইউরোপীয় (আমেরিকাকেও এরই অংশ ধরা যেতে পারে) আধিপত্যবাদ এতটাই নিরঙ্কুশ ছিল যে, সেই আধিপত্যজনিত ‘সেভিয়ার-কমপ্লেক্স’ থেকেই ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সাহিত্যকে দলিল-দস্তাবেজ সাহিত্য হিসাবে হলেও কিছুটা জায়গা দিত। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক অপরাধবোধ থেকেও উপনিবেশের সাহিত্যকে অপেক্ষাকৃত বেশি জায়গা দেওয়া হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পেরোতে না পেরোতে ইউরোপের সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে কড়াভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে চৈনিক ও আরব ভাষার দুনিয়া। এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও উদার মানবতার ভান প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার বলতে এখন বিংশ শতাব্দীর মতো একমাত্রিক একটি পরিসরকে বোঝায় না। আল জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক পরিসর নতুন পরিচয়ভিত্তিক সাহিত্যকে সহজে গ্রহণ করছে, অথচ ধ্রুপদি আঙ্গিকের বাংলা কবিতার জন্য সেই দরজা তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ। বাজার আসলে সাহিত্য সমালোচনার চেয়েও নিষ্ঠুর একটা জায়গা।

সাহিত্য সমালোচনা পুরোনো ভালো লেখার নতুন ভালো পুনরাবৃত্তিকে অল্প হলেও ছাড় দেয়। বাজারে ভালো পুনরাবৃত্তিকে কখনোই বিক্রয়যোগ্য বলে ধরা হয় না। ভালো লেখার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেখানে অন্যরকম লেখা, অন্য ধরনের লেখা। সেই লেখা শৈলীর দিক দিয়ে, ভাষাগত দিক দিয়ে খানিক দুর্বল হলেও কোনও ক্ষতি নেই কারণ বিক্রয়যোগ্যতা যতটা নির্ভর করে ‘অন্যরকম’ হওয়ার উপর, ততটা নির্ভর করে না নিছক ভালো হওয়ার উপর। এই কারণেই ভারতের যে সাহিত্যের ধারা সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক বাজারে গৃহীত হয়েছে তা হল দলিত সাহিত্য। দলিত সাহিত্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা ভিন্নতাই  দলিত সাহিত্যকে বাকি ভারতীয় সাহিত্য ধারার তুলনায় অনেক বেশি বিক্রয়যোগ্য করে তুলেছে।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা দেবীর লেখার ভিন্নতা তাঁকে আন্তর্জাতিক বাজার পেতে অনেক বেশি সাহায্য করেছিল তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায়। সাম্প্রতিককালে অনুবাদের পর বাংলা ভাষার যে চারজন সাহিত্যিককে নিয়ে সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে খানিক হলেও চর্চা হয় তাঁরা হলেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুবিমল মিশ্র এবং শহিদুল জহির। চারজনের বিক্রয়যোগ্যতাই কিন্তু গড়েছে তাঁদের লেখার সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ধরনের লেখা হয়ে ওঠায়। সবচেয়ে বড় কথা ভালো লেখার মানদণ্ড যদি এক ও অভিন্ন হয়, তাহলে সেই মানদণ্ডে এই চারজন কখনোই একসঙ্গে ভালো লেখক বলে বিবেচিতই হবেন না। একসঙ্গে ভালো লেখক হিসাবে বিবেচিত না হলেও, তাঁদের কিন্তু একইসঙ্গে বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠতে আটকাচ্ছে না। বাজার এমনই মজাদার এক পরিসর। এই মজাদার পরিসরে লেখক শুধু ভিন্ন হওয়াটুকু সচেতনভাবে করতে পারেন। বাকি দায়িত্ব লেখার প্রকাশ, প্রচার, অনুবাদ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের। প্রচারের সময় নিষ্ঠাবান দক্ষ হকারের মতো হেঁকে হেঁকে বারংবার সেই ভিন্নতাকে ঘোষণা না করলে বাজার সেই লেখার দিকে ফিরেও তাকাবে না। বিপণনে ফেরিওয়ালার মতো কৌশলী আগ্রাসী না হয়ে  উঠতে পারলে বাংলা ভাষার সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সাফল্য নিছক কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

(লেখক শিক্ষক, সাহিত্যিক অনুবাদক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

নোবেল জয়ের আড়ালে এক বঞ্চনার গল্প

  সুমন্ত বাগচী সম্প্রতি ৯৭ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন জেমস...

হরণ করা ভবিষ্যতের খোঁজে জেন–জি

  অশোক ভট্টাচার্য একটি ঢেউ আছড়ে পড়ছে। হিমালয় থেকে প্রশান্ত...

মন ভালো রাখতে হাতিয়ার ছাদবাগান

অভিজিৎ পাল ডিপ্রেশন বা মনখারাপ আজকাল অনেকেরই নিত্যসঙ্গী। তবে তা...

ন্যায়বিচার থমকে হুমকির আড়ালে

দেবাশিস দাশগুপ্ত অক্টোবর মাসটা পার হয়ে গেল। এক বছর আগে...