দিনহাটা: ‘নদী’ নামের তকমা কোনওকালেই জোটেনি। গর্ব করার মতো দাপুটে প্রবহমানতা ও অহংকারী ঢেউয়ের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু গর্ব করার মতো ছিল তার গভীরতা। গভীরতার কথা চিন্তা করে স্থানীয়রা একে ‘কুঁড়া’ বলতেন। যার অর্থ যে কোনও জলাশয়ের গভীর অংশ। আরাধ্য দেবতা মাশানের নামানুসারে এই জলাশয়ের নাম ‘মাশানকুঁড়া’। এই কুঁড়া থেকে আঁকাবাকা পথে একাধিক নালা বেরিয়ে গিয়েছে, যেগুলি স্থানীয় ভাষায় ‘ডারা’ নামে পরিচিত।
কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমার দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুষের কাছে এই জলাশয় জীবনীশক্তির মতো। শুখা মরশুমে চাষের জমিতে জল জুগিয়ে, মাছপ্রেমীদের সুস্বাদু মাছের জোগান দিয়ে এই নালা স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি বর্ষার মরশুমে কৃষিজমির অতিরিক্ত জলধারণ করে ফসল বাঁচিয়ে ডারা কার্যত কৃষকবন্ধু।
দ্বিতীয় খণ্ড ভাংনি গ্রামে ডারার পাশে ৮০ বছর বয়সি গজেন বর্মনের বসবাস। গজেনের কথায়, ‘কুঁড়ায় একটা গোটা বাঁশ ডুবে যাওয়ার মতো গভীরতা ছিল। ডারাগুলিতে সারা বছর জলের গভীরতা একরকম থাকত। আগে তো এত পাম্পসেট ছিল না। এই জল থেকে চাষাবাদ চলত। ডারা না থাকলে কৃষিকাজ সম্ভব হত না।’
দিনহাটা মহকুমার দিনহাটা ভিলেজ-২, বড় আটিয়াবাড়ি, গোবরাছড়া নয়ারহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন অংশে সর্পিলভাবে ছড়িয়ে থাকা এই ডারার উৎপত্তি কোথায়? স্থানীয় সূত্রে খবর, দিনহাটা-১ ব্লকের দিনহাটা ভিলেজ-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বামনটারি এলাকার স্থানীয় বানিয়াদহ নদী থেকে এই নালার উৎপত্তি। এরপর সেটি দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে ফের বানিয়াদহ নদীতে মিশেছে। কালক্রমে গতি ও জৌলুস হারিয়েছে বানিয়াদহ। বানিয়াদহের সঙ্গে এই নালা সংযোগ হারিয়েছে। বর্তমানে বিচ্ছিন্ন নালা, স্থানীয়দের কাছে মাশানকুঁড়ার ডারা হিসেবে কোনওক্রমে টিকে আছে। এছাড়া দু’দিক দখল করা, নালায় বীজতলা তৈরি, সার প্রয়োগে ডারা মরেই যাচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ, সমাজ ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি বিঘ্নিত হচ্ছে। পেউলাগুড়ির প্রবীণ মৎস্যজীবী মোফাজ্জেল রহমানের কথায়, ‘মাছ ধরব কী? বর্ষার সময় ছাড়া নালায় জল থাকে না। আশপাশে বড় নদী নেই। বাবা-দাদাদের পেশা ছেড়ে দিনমজুরি করে জীবন চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।’ দিনহাটা-২ ব্লকের খোঁচাবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের ভূগোল শিক্ষক দিগম্বর রায় জানান, নদী ও নালা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের অংশ। নালাটি বুজে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় ভূমিক্ষয়, চাষাবাদের জলসমস্যা, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, কর্মসংস্থান হারানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয়দের সচেতন হতে হবে।