মিড-ডে মিলে শিশু-কিশোরের পেট ভরে। পুষ্টি খানিকটা হয়। স্কুলমুখী রাখে। কিন্তু দুপুরে ওই খাবারের জোগানটা বন্ধ হলে? কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের রিপোর্ট ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে। সমীক্ষাটি মন্ত্রকের ‘ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন ফর এডুকেশন প্লাস (ইউ-ডাইস)’-এর। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলায় প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকে স্কুলছুট নেই বটে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে একলাফে বেড়ে ১৭.৮৫ শতাংশ। ভয়াবহ নিঃসন্দেহে। মিড-ডে মিল বন্ধ হলে নিশ্চিতভাবে নীচু ক্লাসে একই পরিস্থিতি তৈরি হবে।
পরীক্ষানিরীক্ষার তো শেষ নেই। শিক্ষার কাঠামো নিয়ে, পদ্ধতি নিয়ে। শিক্ষকদের নিয়ে। প্রশ্ন হল, লাভ কতটা? অর্থাৎ যাঁদের জন্য এত কাঠখড় পোড়ানো, সেই নবীন প্রজন্ম কী পাচ্ছে? জবাব কে দেবে? সরকারের, প্রশাসনের পরিকল্পনায় আদৌ ভাবনাচিন্তা থাকে বলে মনে হয় না। সদ্য বাংলার শিক্ষা দপ্তরের একটি সিদ্ধান্ত নাকচ হয়ে গেল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তিতে। শিক্ষা দপ্তর প্রাথমিক স্তরে সিমেস্টার চালু করবে ঘোষণা করেছিল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, মজা করে টুইঙ্কল টুইঙ্কল আবৃত্তি করতে শেখা খুদে পড়ুয়াদের ওপর সিমেস্টার আসলে একটি ভারী বোঝা। তাঁর মতে, ছাত্রছাত্রীদের ঘাড় থেকে বোঝা কমানোর নীতির পরিপন্থী এই সিদ্ধান্ত। মূল্যায়নের প্রথা চালু থাকা সত্ত্বেও তাঁর সরকারের শিক্ষা দপ্তর এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নিতে গেল, সেটা কি আদৌ বোধগম্য? যদিও সমীক্ষা বা গবেষণার ভিত্তিতে এরকমটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষা দপ্তর তা মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনল না কেন?
এরকম নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় নেই শিক্ষা কর্তৃপক্ষের, সরকারের। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক সদ্য কলমের এক খোঁচায় পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়েছে। তাহলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রথার কী হবে? সেই প্রথার আদৌ প্রাসঙ্গিকতা থাকবে কি? ধারাবাহিক মূল্যায়নের গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ নেই। যদিও সেই মূল্যায়ন বাস্তবে যে ধারাবাহিক ও আন্তরিক থাকে না সবসময়, তার প্রমাণ ইতিপূর্বে মিলেছে।
পাশ-ফেল হোক বা মূল্যায়ন- বিষয়টি যাই হোক, সাফল্য নির্ভর করে আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ওপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই গোড়ায় গলদ। ফলে পড়ুয়ারা পরীক্ষানিরীক্ষার গিনিপিগ হয়। কিন্তু তাদের লেখাপড়া, মানসিক বিকাশ ইত্যাদি এগোয় না। প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক স্তরে মিড-ডে মিল নির্ভর হয়ে থাকে শিক্ষা। চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠছে- সরকারি স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা কমছে।
পড়ুয়ার অভাবে সদ্য একটি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে উত্তরবঙ্গের মাদারিহাট ব্লকে। আরও কিছু স্কুলে একই পরিস্থিতি। কোথাও শিক্ষক সংখ্যার চেয়ে পড়ুয়া কম। কেন এই অবস্থা? সহজ, সাধারণ যুক্তি দেওয়া হয়, সন্তানদের শিক্ষায় অভিভাবকদের ঝোঁক এখন বেসরকারি স্কুলে। সেই যুক্তি যদি সত্যিও হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেসরকারি স্কুলের মতো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় না কেন?
এত ধারাবাহিক মূল্যায়ন, হলিস্টিক রিপোর্টের কথা বলা হয়, তাহলে পড়ুয়াদের ধরে রাখতে না পারা তো সরকারি ব্যর্থতা। সেই খামতির প্রতিকার না করে সরকার কী করতে চলেছে? সদ্য শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, পড়ুয়া সংকটে ধুঁকতে থাকা স্কুলকে চালু স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হবে। তিনি সম্ভবত ভেবে দেখেননি, এতে অনেক পড়ুয়ার বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব বাড়বে।
যে সমস্যা স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। স্কুলের প্রতি আকর্ষণ নষ্ট হতে পারে। এই ব্যবস্থায় শিক্ষকের চাকরি নিরাপদ হতে পারে। কিন্তু পড়ুয়াদের পড়াশোনা নিশ্চিত হবে কি না সন্দেহ। এখন প্রাথমিক স্কুলগুলিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত জানার কাজ চলছে। যা শেষ হলে স্কুল সংযুক্তি আরও নিখুঁত হবে। এই মনোভাবে গুরুত্ব পাচ্ছেন শিক্ষকরা। পড়ুয়া কিংবা শিক্ষা নয়। দুর্ভাগ্য এটাই।