মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

জল মাপতেই বঙ্গ সফরে ভাগবত

শেষ আপডেট:

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

ছাব্বিশ বছর পর দিল্লির তখত দখল করেছে বিজেপি। রাজ্য হিসাবে দিল্লি যদিও যথেষ্ট ছোট, কিন্তু ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির এই দিল্লি জয়ের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। দিল্লি জয়ে এবার যথেষ্টই মরিয়া ছিল বিজেপি। দিল্লি জয়ের জন্য কোনও অস্ত্রেই তারা শান দিতে কসুর করেনি। এরই পাশাপাশি আরএসএস সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল দিল্লিতে বিজেপিকে জিতিয়ে আনতে। আরএসএস যেমন করে থাকে, নিঃশব্দে, উইপোকার মতো, তেমনই কেজরিওয়ালের ঘরের মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে বিজেপির জন্য সুড়ঙ্গ বানিয়ে দিয়েছিল। দিল্লিতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আরএসএসের হিন্দুত্বের নিঃশব্দ প্রচার বিজেপির সহায়ক হয়েছে এ অস্বীকার করা যাবে না। বিজেপি-আরএসএসের এই সম্মিলিত কৌশলের মুখে কেজরিওয়ালের গোঁ আর কংগ্রেসের ইগো বিজেপির পথ আরও প্রশস্ত করে তুলেছে।

বিষয়টা বিজেপির দিল্লি বিধানসভা দখলেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। যাঁরা জাতীয় রাজনীতির খবর রাখেন, তাঁরা সকলেই মানছেন, কেজরিওয়ালকে পরাস্ত করে উজ্জীবিত বিজেপি এবার অন্য বিরোধীদের দিকে তার থাবা আরও প্রসারিত করবে। এই বছরের শেষে বিহার বিধানসভার নির্বাচন। সামনের বছর এই রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। এটা এখন থেকে আন্দাজ করা খুব কঠিন নয় যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তেজস্বী যাদবকে মোকাবিলা করতে বিজেপি-আরএসএস যৌথ আক্রমণ চালাবে। বিজেপি প্রকাশ্যে, আরএসএস তাদের কর্মপন্থা অনুসারে অন্তরালে।

এতখানি কথা এই জন্যই বললাম যে, দিল্লি যখন জিতে নিচ্ছে বিজেপি, তখন এই রাজ্যে এক দীর্ঘ সফরে এসেছেন সংঘের সরসংঘচালক মোহন ভাগবত। ভাগবতের এই সফরটি নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু ভাগবতের সফরকে গুরুত্ব না দেওয়া অনুচিত হবে। বিশেষ করে দিল্লি নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে যদি এই সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে এই রাজ্যের রাজনীতিতেও এই সফরের গুরুত্ব কতখানি।

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, কোনও রাজ্যে এত দীর্ঘদিনের সফর সংঘপ্রধান করেন না। এই রাজ্যের ক্ষেত্রে এবার তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। এই রাজ্যে এবার ভাগবতের সফরসূচি নয়-দশদিনের। যা শুনলাম, তাতে সোমবার কলকাতায় সংঘের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের সদর দপ্তরে এই প্রান্তের বিভিন্ন সাংগঠনিক বৈঠক করেছেন ভাগবত। মঙ্গল ও বুধবার এই কলকাতাতেই সংঘের অখিল ভারতীয় সভা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কলকাতায় সংঘের অখিল ভারতীয় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ১৪ তারিখ বর্ধমানে সংঘের নতুন কার্যালয়ের উদ্বোধন করবেন। ১৬ তারিখ বর্ধমান জেলার তালিতে কর্মী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন। এর আগে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি শহিদ মিনারে সংঘের এক সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন ভাগবত। এরই ফাঁকে গত শনিবার সংঘপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আরজি কর হাসপাতালে নিহত তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মা।

সর্বদাই নিজেকে যেমন একটা ঘেরাটোপের অন্তরালে ঘিরে রাখতে চায় আরএসএস, এক্ষেত্রেও সংঘপ্রধানের এই দীর্ঘ বঙ্গ সফর সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছে তারা। তারা যতই মুখে কুলুপ আঁটুক এটুকু বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কারণ নয় যে, সংঘপ্রধান জলহাওয়া পরিবর্তনের জন্য এই রাজ্যে দীর্ঘ সফরে আসেননি। তাঁর এই সফরের পিছনে একটি গূঢ় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই রয়েছে।

সংঘের লৌহপ্রাচীরের ফাঁক গলে যেটুকু খবর ছিটকে-ছাটকে আসছে, তাতে বোঝা যাছে ’২৬-এর নির্বাচনের আগে এই রাজ্যে জল মাপতে এসেছেন সংঘপ্রধান। এই সফর থেকেই আগামী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনকে পাখির চোখ করে আরএসএসের প্রচারের রূপরেখাটি তৈরি করে দিয়ে যাবেন। সেই রূপরেখা অনুসারে আরএসএস অবিলম্বে তাদের নিঃশব্দ প্রচারাভিযান, যাকে হুইসপারিং ক্যাম্পেন বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না, শুরু করে দেবে।

লক্ষণীয়, এই সফরে তিনদিন দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের সাংগঠনিক বৈঠক সারবেন সংঘপ্রধান। তারপর দু’দিন অখিল ভারতীয় সভা। এই বৈঠকগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতের কর্মপন্থাও ছকে ফেলা হবে। যাঁরা আরএসএসের কর্মপন্থা সম্পর্কে অবহিত, তাঁরা জানেন আরএসএস তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপির অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টটি সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে প্রধানত বেশি ভরসা করে বিভিন্ন রাজ্যের সংঘের কার্যকর্তাদের ওপর। এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও তাই।

এর আগে রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে এই রাজ্যের সংঘ কর্মকর্তারা যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তা সংঘপ্রধানকে খুশি করতে পারেনি। হালে এই রাজ্যে বিজেপির অবস্থা সংঘের কার্যকর্তাদের বিজেপি সম্পর্কে আরও ক্ষুব্ধ করেছে। বিজেপির অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা যে সরকার গঠনের অবস্থায় বিজেপিকে পৌঁছে দিতে পারবে না তা উপলব্ধি করেছেন সংঘের কার্যকর্তারা। ফলে এবারেও সাংগঠনিক বৈঠকে বিজেপি সম্পর্কে তাঁদের রিপোর্ট সংঘপ্রধানকে খুশি করবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে রাজ্য বিজেপির নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গেও সংঘপ্রধান কথা বলতে পারেন।

এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপির দুর্বল সংগঠনের ওপর ভরসা না করে সংঘকে নিজের মতো করে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার করতেই পরামর্শ দেবেন সংঘপ্রধান। অবশ্য বরাবরই সংঘে নিজের মতো একটি বিকল্প প্রচারের রূপরেখা তৈরি করে। সেটা প্রধানত বাড়ি বাড়ি প্রচার, বিভিন্ন ধরনের পত্রপত্রিকা বিলি এবং প্রবুদ্ধ সভার মাধ্যমে তৃণমূল স্তরে একটি জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। বিজেপির বিশৃঙ্খল সাংগঠনিক অবস্থায় সংঘের তৃণমূল স্তরের বাড়ি বাড়ি প্রচারেই সংঘপ্রধান বেশি গুরুত্ব দেবেন, এটাই অনুমেয়।

এই দীর্ঘ সফরে তাহলে আরএসএসের দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গ প্রান্তকে কী নির্দেশ দিয়ে যেতে পারেন সংঘপ্রধান? শতবর্ষে পা রেখে আরএসএসের এখন প্রধান অস্ত্র হিন্দুত্ব। যে অস্ত্রে বিজেপিকে ক্রমাগত শান দিয়ে যেতে আরএসএসই বলেছে। রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনই ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা হয়েছে, এমন উক্তি করে সংঘপ্রধান ভাগবত নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি উগ্র হিন্দুত্বের হাতিয়ারেই ভরসা রাখতে চাইছেন। সেক্ষেত্রে ’২৬-এর নির্বাচনের আগে আরএসএস এবং বঙ্গ বিজেপিকেও সেই অস্ত্রে কীভাবে শান দেওয়া যায় সে পরামর্শই দিয়ে যাবেন তিনি। সাংগঠনিক শক্তিতে নয়, হিন্দুত্বের হাওয়া তুলে যতটুকু লাভবান হওয়া যায়, সে চেষ্টাই করতে বলবেন।

আরএসএস-ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভাগবতের এই সফর নিয়ে। তাঁর বিশ্লেষণ, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এই রাজ্যে হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে তোলার একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এই রাজ্যে হিন্দুদের ভিতর যতটা প্রভাব ফেলবে অতটা অন্য রাজ্যে নয়। বিশেষ করে, রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা বিধানসভাগুলিতে হিন্দুদের একটা বড় অংশের ভিতর প্রভাব পড়বে।’ এই পরিস্থিতিকে কি কাজে লাগাতে চান ভাগবত? উত্তর এল, ‘এখন থেকেই সীমান্ত এলাকাগুলিতে এবং যেসব কেন্দ্রে হিন্দু ভোটার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, সেসব জায়গায় বাড়ি বাড়ি প্রচার চালিয়ে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার পরামর্শই সংঘপ্রধান দিয়ে যাবেন।’

এতে কি বাজিমাত করা যাবে শেষ পর্যন্ত? আরএসএস-ঘনিষ্ঠ ওই বিজেপি নেতাটি বলছিলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প হওয়ার মতো কোনও নেতা আপাতত এই রাজ্যে নেই। সেটা আরএসএস জানে। বিজেপিও জানে। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে যতই দুশো পারের কথা বলা হোক না কেন, সংঘ এবং বিজেপি দু’পক্ষই জানত ক্ষমতা এখনও দূর অস্ত। লক্ষ্য ছিল কর্মীদের উজ্জীবিত করে আসনসংখ্যা বাড়ানো।’ তাঁর পরবর্তী সংযোজন, ‘দুর্ভাগ্য, গতবার বিধানসভা ভোটের পর যত দিন গিয়েছে, রাজ্য বিজেপি ততই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। সেই জায়গা থেকে বিজেপিকে তুলে ধরতে একটা চেষ্টা তো করবেই সংঘ। আর সেজন্য এবার হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার লক্ষ্যে আরএসএস ক’দিনের ভিতরই সীমানাঘেঁষা এলাকাগুলোয় নিবিড়ভাবে নিঃশব্দ প্রচার চালানো শুরু করবে। ক্ষমতা হয়তো এবারও দখল করা সম্ভব হবে না। তবে অন্তত একশোর কাছাকাছি বিজেপিকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবে সংঘ।’

শেষ পর্যন্ত ভাগবতের কৌশলে কতটা পদ্ম বাংলার মাটিতে ফুটবে, তা বলে দেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পালটা কৌশল।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পনেরোর নামতায় বুধরামদের দুঃস্বপ্ন

  সুকান্ত নাহা বুনোট ন্যাড়া হয়ে যাওয়া জমিটা এখন প্রায়...

মিল-অমিলের যুদ্ধে যাদবপুর-জেএনইউ

  জয়ন্ত ঘোষাল জেএনইউ এবং যাদবপুর যেন দু’ভাই। যদিও দুজনের...

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...