বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

‘অমৃতে’ মোহন কাঁটা

শেষ আপডেট:

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট সহ আরএসএসের সমস্ত সমালোচক এবং বিরোধীদের অভিযোগ, স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস কখনও অংশ নেয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন ভারতের সংবিধান, জাতীয় পতাকাকে মান্যতা না দেওয়ার অভিযোগও আরএসএসের বিরুদ্ধে আছে। নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তরে দীর্ঘদিন ১৫ অগাস্ট কিংবা ২৬ জানুয়ারিতে ভারতের জাতীয় পতাকা তোলা হয়নি।

এই ধরনের অভিযোগ উঠলে আরএসএস নেতারা সাধারণত মন্তব্য করেন না। নীরবে সকলের নজরের আড়ালে হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা পূরণে কাজ করে চলেন। কিন্তু সদ্য আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যে মন্তব্য করেছেন, তা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস ও স্বীকৃতিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে একটি অনুষ্ঠানে নিজের বক্তৃতায় সরসংঘচালক ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট নয়, ভারত প্রকৃত অর্থে গতবছর অযোধ্যায় রাম মন্দিরে দ্বারোদ্ঘাটন হওয়ার দিন স্বাধীনতা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।

তাঁর যুক্তি, রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দ্বাদশীর দিনটিকেই ভারতের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে উদযাপন করা উচিত। ভাগবত কথায়, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত ব্রিটিশদের থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছিল মাত্র, ভারতবাসী প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পর তৈরি সংবিধান সময়ের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে রচিত হয়নি। তাঁর মতে, ভারত বহু শতাব্দীর শোষণের শিকার ছিল। রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠার দিনই সেই শোষণ থেকে মুক্তি পেয়ে সত্যিকারের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সরসংঘচালকের এমন কথায় বিতর্ক উসকে ওঠা খুব স্বাভাবিক। লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি ওই মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন। অন্য কোনও দেশ হলে এই মন্তব্যের জন্য ভাগবতকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে জেলবন্দি করা হত বলে মন্তব্য করেছেন। বুধবার নয়াদিল্লিতে কংগ্রেসের নতুন দপ্তরের দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য ছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল হল ভারতের সংবিধান।

মোহন ভাগবত প্রতি দু’-তিনদিন অন্তর দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, সংবিধান সম্পর্কে কী ভাবেন তা বলার ঔদ্ধত্য দেখান বলে রাহুল মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, সরসংঘচালকের ওই উক্তি এক অর্থে রাজদ্রোহ। কারণ এভাবে উনি সংবিধানকে অবৈধ বলেছেন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইকে অবৈধ বলেছেন। ভাগবতের সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও। তিনি একপ্রকার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সংঘ প্রধান এই ধরনের কথা বলতে থাকলে তাঁর পক্ষে দেশে ঘুরে বেড়ানো কঠিন হবে।

শিবসেনাও (ইউবিটি) সংঘ প্রধানের বক্তব্যের সমালোচনা করেছে। স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে এমন স্পর্শকাতর বক্তব্য সম্পর্কে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি এখনও বিরোধিতা দূরে থাক, কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। ২০২২ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দেশজুড়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। একাধিক অনুষ্ঠান, কর্মসূচির জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে প্রচারও করেছিল মোদি সরকার।

সম্প্রতি ভারতের সংবিধানের ৭৫ বছরও পালন করেছে কেন্দ্র। তা নিয়ে সংসদের উভয় কক্ষে ব্যাপক আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে। ফলে দেশের স্বাধীনতা দিবস, সংবিধান নিয়ে মোহন ভাগবতের মন্তব্য সম্পর্কে সবার আগে মোদি এবং তাঁর সরকারের প্রতিক্রিয়া কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু বিজেপির তাত্ত্বিক সংগঠনের প্রধান নেতার মন্তব্য নিয়ে টুঁ শব্দ করেনি কেন্দ্র।

আরএসএসের গর্ভে যে দলের জন্ম, তার পক্ষে সংঘ প্রধানের বিরোধিতা করা কার্যত অসম্ভব। ঠারেঠোরে প্রশ্ন তুললেও যে পরিণাম হয়, সেটা গত লোকসভা ভোটের ফলাফলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বিজেপি। আরএসএসের সাহায্যের প্রয়োজন নেই বলে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডার বক্তব্যের জেরে বিজেপি প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল ভোটের ফলাফলে। যদিও পরে হরিয়ানা থেকে মহারাষ্ট্র সর্বত্র, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য এসেছে আরএসএসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে ও সাংগঠনিক তৎপরতায়।

দিল্লিতে আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে সংগতকারণে আরএসএস-কে চটাতে চাইবে না পদ্ম শিবির। আরএসএস প্রধান যে মন্তব্যই করুন, তাতে অবশ্য দেশের ইতিহাস বদলে যাবে না। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্তের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীন হয়েছিল। সেই স্বাধীনতার ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হওয়ায়। এই দুটি তথ্য ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা কঠিন।

অযোধ্যার রাম মন্দির নিশ্চয়ই দেশ-বিদেশের কোটি কোটি ভক্তর কাছে আস্থার প্রতীক। রামলালা তাঁদের কাছে আরাধ্য দেবতা। এর সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জড়িয়ে ইতিহাসকে ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা আসলে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের অ্যাজেন্ডার সমার্থক। তাতে নতুন প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে মাত্র।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পদ্মের চালে তসলিমা  

চৌষট্টি খোপের দাবায় রাজা-মন্ত্রী, হাতি-ঘোড়া-নৌকার চেয়ে বিপদে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে...

সর্বব্যাপী নীতিহীনতা

রাজনীতিতে দলবদলের প্রসঙ্গ উঠলে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ কাহিনী আসবেই। বহুলপ্রচলিত...

সুখের খোঁজ

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘সবাই তো সুখী হতে...

অনগ্রসরতা ও রাজনীতি

ওবিসি (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। মামলাটি...