প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান: মেয়ে ফিরদৌসী উচ্চ শিক্ষত। এম-এ পাশ করেছে। কিন্তু তাঁর মা ও দাদা মাধ্যমিকের গণ্ডী পার হতে পারেনি বলে ফিরদৌসীর আক্ষেপের অন্ত ছিল না। এবার ফিরদৌসীর আক্ষেপ মিটল। তাঁর অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ফের লেখাপড়া শুরু করে মাধ্যমিক পাশ করল মা ও দাদা। ফিরদৌসীর মা মা আয়েশা বেগম ৩৮৫ নম্বর আর দাদা পারভেজ আলম ৪৬২ নম্বর পেয়ে এক সুযোগেই মাধ্যমিক পাস করেছেন।
আয়েশা বেগমের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড় থানার ঘাটশিলা গ্রামে। তাঁর স্বামী শেখ সাইফুল আলম পেশায় কৃষিজীবী। নিম্নবিত্ত পরিবারের এই দম্পতির পুত্র পারভেজ আলমও ছয় বছর আগে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছিল। কিন্তু পারভেজের বোন ফিরদৌসী খাতুন সেই পথে হাঁটেননি। পারিবারিক আর্থিক প্রতিকুলতার মধ্যেও ফিরদৌসী লেখাপড়া চালিয়ে যান। ইতিমধ্যে তিনি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম-এ পাশ করে ফেলেছেন। এখন চাকরির জোগাড়ের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
নিজে উচ্চশিক্ষিত হতে পারলেও আইসিডিএস কর্মী মা ও দাদার কম শিক্ষিত হয়ে থাকাটা ব্যাথিত করতো ফিরদৌসীকে। তাই তিনি তাঁর মা ও দাদাকে ফের শিক্ষার আঙিনায় ফিরিয়ে আনার জন্য লাগাতার অনুপ্রাণিত করে চলেন। তাতে কাজও হয়। ফিরদৌসীর মা ও দাদা দু’জনেই ঘাটশিলা সিদ্দিকীয়া সিনিয়ার হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যান। পড়াশুনা করে এ বছর তাঁরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই বাজিমাত করে ফেলেন। স্ত্রী ও ছেলে একসাথে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করে যাওয়ায় বেজায় খুশি ফিরদৌসীর বাবা সাইফুল আলম। তাঁর কথায়, ‘আমার ছেলে ও স্ত্রী সত্যি দৃষ্টান্ত তৈরি করল।’ আয়েশা বেগম এদিন জানান, তাঁর শৈশব জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। ছোট বয়স থেকেই তিনি তাঁর বাবাকে কাছে পান নি। মামার বাড়িতেই কষ্টের মধ্যে বড় হন। প্রায় ২৫ বছর আগে সেখানকার স্কুলে সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার তিন মাস পর থেকে তাঁকে লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয়। তারপর বিয়ে হয়ে গেলে সংসার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছেলে ও মেয়েকে বড় করে তুলে তাদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব তাঁকে কাঁধে নিতে হয়। তারই মধ্যে ২০১০ সাল বর্ধমানের একটি আইসিডিএস কেন্দ্রে কাজে যোগ দেন।
আয়েশার কথায়, সংসার ও আইসিডিএস কেন্দ্রের কাজ সামলেও যে লেখাপড়া করে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া যায় এই অনুপ্রেরণা তিনি তাঁর মেয়ের কাছ থেকেই পান। মেয়ের অনুপ্রেরনাতেই সংসার সামলে রাতে পড়াশোনা করতেন। আর এবার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ও সমালোচনাকে দূরে সয়িয়ে রেখে ছেলের সঙ্গে তিনিও মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। পাস করে যাবেন এই প্রত্যাশা ছিল। আর সেটাই হয়েছে। এর পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ারও ইচ্ছাও রয়েছে বলে আয়েশা বেগম জানিয়েছেন। আয়েশার মত তাঁর ছেলে পারভেজ আলমও দাবি করেছেন, তিনি তাঁর বোন ও বাবার অনুপ্রেরণাতেই আবার লেখাপড়ার জীবনে ফিরে এসেছেন। পারভেজ বলেন, ‘আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। অনটনই ছিল আমাদের পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই অবস্থায় শুধুই মনে হত কোন কাজে যোগ দিয়ে আমাকে উপার্জন করতে হবে। নয়তো আমাদের সংসারটা ভেসে যাবে। তাই ছয় বছর আগে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেই আমি লেখাপড়ায় ইতি টানি। তার পর মুম্বইয়ে গিয়ে অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলাম। কিন্তু লেখাপড়া ছাড়তে হওয়ায় মনে আক্ষেপ রয়েই গিয়েছিল।’ পারভেজও জানিয়েছে, সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চায়। আয়েশা বেগম ও তাঁর ছেলে পারভেজ মেমারি হাই মাদ্রাসা পরীক্ষাকেন্দ্রে বসেই পরীক্ষা দিয়েছিল। মা ও ছেলে দু’জনেই পাস করেগেছে জেনে ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক তোরাব আলী বলেন, ‘প্রকৃত অর্থেই আয়েশা ও তাঁর ছেলে পারভেজ দৃষ্টান্ত তৈরি করলো। যাঁরা লেখাপড়া শেষ করতে পারেন নি তাঁরা যদি এই মা ও ছেলেকে দেখে অনুপ্রাণিত হন তাহলে সমাজ উন্নত হবে।’