নিউজ ব্যুরো, কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ: বাংলাদেশি মৌলবাদী সংগঠনগুলিই বাংলাদেশে গণ্ডগোল পাকিয়েছে বলে অভিযোগ। মূলত জামাত-উল মুজাহিদিন (বাংলাদেশ) অর্থাৎ জেএমবি এবং আনসারুল্লা বাংলা টিম (এবিটি) মুর্শিদাবাদের (Murshidabad Unrest) অশান্তির পিছনে বলে নবান্নে (Nabanna) রিপোর্ট দিয়েছে রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তর। বিএসএফের গোয়েন্দারাও প্রায় একইরকম রিপোর্ট দিয়েছেন এই আধাসামরিক বাহিনীর দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের আইজির কাছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটেছে মৌলবাদীদের। বেশ কিছুদিন ধরেই এ রাজ্যে গোলমাল পাকানোর ছক ছিল তাদের। ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে কিছু লোকের অসন্তোষে ওই মৌলবাদীরা হাতে অস্ত্র পেয়ে যায়। স্থানীয়দের উসকে অশান্তি পাকায়। বিএসএফের (BSF) রিপোর্টে মূলত নিশানা করা হয়েছে জেএমবি-র দিকে।
রবিবার অবশ্য জঙ্গিপুর মহকুমার সুতি, সামশেরগঞ্জে আর কোনও গোলমালের খবর নেই। তবে এলাকার অধিকাংশ দোকানপাট খোলেনি। অঘোষিত বনধের ছবি চারদিকে। আতঙ্কিত স্থানীয়রা। রবিবার সকাল থেকে মোট ৯ কোম্পানি বিএসএফ এবং রাজ্য পুলিশ এলাকায় টহল দিতে শুরু করে। রাতে রাঁচি, জামশেদপুর ও রাজারহাট থেকে আরও ৫ কোম্পানি সিআরপিএফ মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়েছে।
রাজ্যের সীমান্তবর্তী আরও কিছু এলাকায় হিংসা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বিএসএফের রিপোর্টে। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে রবিবার বৈঠক করেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার এবং এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম। ডিজি পরে জানান, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। মোট ১৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে খুন, খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযোগ, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর, সরকারি আধিকারিকদের কাজে বাধা সহ একাধিক অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়েছে।
আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘ফেক ভিডিও ছড়িয়ে গোলমাল আরও বাড়ানো হয়েছে। ওই ফেক ভিডিওগুলির আইপি অ্যাড্রেস ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’ বিএসএফের রিপোর্ট অনুযায়ী, জঙ্গিপুর মহকুমায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় পুরোটাই নদীবেষ্টিত বলে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় অবাধে যাতায়াতের সুযোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা।
বিএসএফের দাবি, গত কিছুদিন ধরে ভারতীয় নাগরিকদের একাংশকে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছিল কখনও মুখোমুখি, কখনও ভিডিও কনফারেন্সে। জঙ্গিপুর সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জঙ্গি ও দুষ্কৃতীদের ডেরা হিসাবে কুখ্যাত। সেখান থেকে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। এপারে হামলাকারীদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজ্য গোয়েন্দারা আরশাদ, মেহবুব ও নজরুল নামে এবিটি স্লিপার সেলের তিনজনের সন্ধান পেয়েছে। তাদের খোঁজে তল্লাশি করছে পুলিশ। নতুন কোনও অপ্রীতিকর কিছু রবিবার না ঘটলেও রাজনৈতিক চাপানউতোর চরমে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছে। সেই কারণে এই অশান্তি। রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এর দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিতে হবে।’
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের পালটা অভিযোগ, ‘কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢুকিয়েছে বিজেপিই। মুর্শিদাবাদের গোলমালে তারাই যুক্ত। বিজেপি ফেক ভিডিও ছড়িয়ে এলাকা উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ সময়মতো কঠোর পদক্ষেপ করেছে। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব বিএসএফের। তাদের নজর এড়িয়ে কী করে বাংলাদেশি মৌলবাদীরা এই রাজ্যে ঢুকল? এখানেই বিজেপির চক্রান্ত স্পষ্ট।’
মুর্শিদাবাদের এই ঘটনায় মন্তব্য করেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও। লখনউয়ের একটি অনুষ্ঠানে রবিবার তিনি বলেন, ‘ওয়াকফ আইন নিয়ে হিংসা উসকে দেওয়া হচ্ছে মুর্শিদাবাদে। হিন্দুদের খুন করা হচ্ছে। তাদের বাড়ি, গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুর্শিদাবাদে হিংসার পিছনে সংকীর্ণ রাজনীতি রয়েছে। বিশৃঙ্খলা তারাই করছে, যাদের ওয়াকফ আইনের ফলে স্বার্থে আঘাত লেগেছে।’
ধুলিয়ানে রাস্তা রবিবার প্রায় জনশূন্য ছিল। প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বেরোননি। বিএসএফের উপস্থিতির কারণে নতুন করে অশান্তি হয়নি বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। সে কারণে কেউ কেউ চাইছেন বিএসএফ পাকাপাকিভাবে মোতায়েন থাকুক। বিএসএফের পক্ষ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, যতদিন পুলিশ চাইবে, ততদিনই তারা থাকবে।
বিভিন্ন বাড়ির ছাদে মজুত প্রচুর পাথর-ইট রবিবার খালি করিয়েছে বিএসএফ। মুর্শিদাবাদে অতিস্পর্শকাতর এলাকাগুলি আধাসেনা চিহ্নিত করে নজর রেখেছে। জঙ্গিপুরের পুলিশ সুপার আনন্দ রায় বলেন, ‘কেউ যেন গুজবে কান না দেয়। কারও কিছু সন্দেহ হলে যেন আমাদের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করেন। কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক, আমরা বলে দেব। দক্ষিণ মালদার কংগ্রেস সাংসদ ইশা খান চৌধুরী সামশেরগঞ্জে যান।
(তথ্য সহায়তাঃ দীপ্তিমান মুখোপাধ্যায়, অর্ণব চক্রবর্তী ও পরাগ মজুমদার)