শুভঙ্কর চক্রবর্তী, গেলেফু (ভুটান) : ভারতের নজর এড়িয়ে ভুটানে কি কোনও গোপন গবেষণা শুরু করেছে চিন? সেই গবেষণা কি ভাইরাস সংক্রান্ত? আর সেই গবেষণার জন্যই কি চিনা মদতে ভুটানজুড়ে একাধিক অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরি হচ্ছে?
এই প্রশ্নগুলোই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে। কারণ ভুটানের ছয়টি নির্জন এলাকায় কার্যত যুদ্ধকালীন তত্পরতায় প্রায় তিন হাজার বেডের পরিকাঠামোযুক্ত কোয়ারান্টিন সেন্টার তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি সেন্টারের সঙ্গেই থাকছে একটি করে বিশালাকৃতির গবেষণাগার।
নির্মীয়মাণ সেন্টারগুলির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কাউকেই কার্যত ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না। কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে কোয়ারান্টিন সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেন নতুন করে সেন্টার এবং তার সঙ্গে গবেষণাগার তৈরি করছে ভুটান, সেই রহস্য এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি গোয়েন্দাকর্তারা।
সবথেকে বড় কোয়ারান্টিন সেন্টার ও গবেষণাগার তৈরি হচ্ছে চারদিকে পাহাড় ঘেরা গেলেফু-এর সরপংয়ে একটি নির্জন এলাকায়। প্রায় ৩০ একর জমির উপর এক হাজার বেডের বিশাল সেই সেন্টার তৈরি করছে ভুটান। এছাড়াও কোয়ারান্টিন সেন্টার তৈরি হচ্ছে ফুন্টশোলিং, সামদ্রুপ জংখার, সমতসেতেও। ১১ জুনের মধ্যে সমস্ত সেন্টার ও গবেষণাগার তৈরির কাজ শেষ করতে নির্মাণের বরাতপ্রাপ্ত সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে ভুটান সরকার। সেই অফিশিয়াল নোট হাতে পেয়েছেন ভারতের গোয়েন্দারা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের খবর, শুধুমাত্র গেলেফু সেন্টারের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মাণকাজের জন্যই ভুটানি মুদ্রায় প্রায় এক বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ হয়েছে। গবেষণাগারের বরাদ্দ আলাদা। অন্য সেন্টারগুলির হিসেব অবশ্য পাওয়া যায়নি। কোভিডের সময় থেকেই চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে ভুটান। কিছুদিন আগেও সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা ভুটানের সরকারি কোষাগারে ছিল না। সেই ভুটান শুধুমাত্র সতর্কতার জন্য বা আগাম প্রস্তুতি হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছে, এমনটা কোনওভাবেই মানতে নারাজ দুঁদে গোয়েন্দাদের একাংশ। বিদেশি সহযোগিতা ছাড়া ওই পরিমাণ অর্থ খরচের মতো অবস্থায় যে ভুটান নেই, তা নিয়ে গোয়েন্দারা একমত।
গেলেফুতে কোয়ারান্টিন সেন্টার ঘেঁষেই দ্বিতল কেন্দ্রীয় গবেষণাগার তৈরি হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত মানচিত্র অনুসারে গেলেফুতে আলাদা আলাদা মোট ৪৫টি ব্লক তৈরি হচ্ছে। গবেষণাগারের ভেতরেই থাকা, খাওয়া ও রান্নার বন্দোবস্ত রয়েছে। প্রতিটি ঘরেই থাকছে বাতানুকূল যন্ত্র। নির্মাণকাজে বিশেষ ধরনের স্টিল ব্যবহার করা হচ্ছে। গবেষণাগারের বর্জ্য ও জল প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অন্য একটি এলাকায় নিয়ে ফেলার জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেন্টারে ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য পাহাড় কেটে নতুন তিনটি রাস্তা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে গেলেফুতে।
গোয়েন্দাদের একাংশের আশঙ্কা, বিশেষ কোনও ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রযোগের জন্য ওই সেন্টার ও গবেষণাগার তৈরি করা হচ্ছে। ভুটানকে সামনে রেখে আদতে চিন ওই কাজ করছে। সেন্টারগুলো বকলমে চিনারাই পরিচালনা করবে। ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য ভুটানে থাকা ভারতীয় শ্রমিকদের টার্গেট করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। মনে রাখতে হবে, ভুটানের নির্মাণকাজ, শিল্প সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয় শ্রমিকদের সংখ্যাই সবথেকে বেশি।
গেলেফুতে সেন্টার তৈরিতে বাছাই করা শ-তিনেক শ্রমিক দিনরাত কাজ করছেন। সেই শ্রমিকদের সেন্টারের বাইরে যাতায়াতের উপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওই এলাকায় বা সেন্টারের ভেতরের ছবি তুলতেও দেওয়া হচ্ছে না। সেন্টারের চারদিকে অস্ত্রধারী নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া পাহারায় বসানো হয়েছে। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সেন্টারের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে।
এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্তার কথায়, প্রায় আড়াই বছর ধরে ভুটান তাদের দেশের দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। ওই সময়ে মধ্যে সেদেশের ভেতরে কী হয়েছে, সেটা কেউই জানে না। এইসব কোয়ারান্টিন সেন্টারকে সামনে রেখে অনেক কিছুই হতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে চিনের প্রতি ভুটানের নরম মনোভাব এবং তারপরই সেই দেশজুড়ে গোপনীয়তা বজায় রেখে কোয়ারান্টিন ও গবেষণাগার তৈরি ভারতীয় গোয়েন্দাদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে।