Sunday, February 16, 2025
Homeক্যাম্পাসNature Camp | প্রকৃতির কোলে প্রকৃত পাঠ

Nature Camp | প্রকৃতির কোলে প্রকৃত পাঠ

অনিমেষ বসু (প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, ন্যাফ, শিলিগুড়ি) : চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ শৈশব। সেই শৈশব যখন সুযোগ পায় ডানা মেলে ওড়ার, তাকে সঙ্গ দেয় প্রকৃতি। শীতের সকালটা শুরু হয় বেড টি দিয়ে। তারপর দিনভর অ্যাডভেঞ্চার। সুষম খাবার। যারা বাড়ি-স্কুল-টিউশনের গোলকধাধায় বন্দি থাকে সারাবছর, তারা এখানে ছুটে বেড়ায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। মাটিতে গড়াগড়ি খায়। বাড়িতে যে পাঁচমিশালি সবজি দেখলে মুখ বেজার করে, সেটাই এখানে চেটেপুটে হজম করে। ওরা প্রকৃতির কোলে ‘নিয়ম’ ভাঙে।

শীত পড়লে উত্তরবঙ্গের জঙ্গল, পাহাড়ের কোনও এক মাঠে রংবেরঙের তঁাবু খাটিয়ে বসে প্রকৃতি পাঠের শিবির। প্রতিবছর বিভিন্ন বয়সি শিশু-কিশোররা তাতে অংশ নেয়। উদ্যোক্তা মূলত বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন। তাছাড়া কিছু স্কুল এক থেকে দু’দিনের আয়োজন করে। তবে পরিবেশপ্রেমী ক্লাব এবং সংগঠনের আয়োজন হয় বেশিদিনের। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে পড়ুয়ারা আসে। পরিবেশ এবং প্রাণীদের জানে-চেনে। উত্তরবঙ্গ তথা রাজ্যে এধরনের শিবির আয়োজনে পথ দেখিয়েছিলেন প্রকৃতিবিদ জগন্নাথ বিশ্বাস। প্রায় সাত দশক আগে।

প্রতিবছর বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্যও আলাদাভাবে শিবিরের আয়োজন হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ওরা অংশ নেয় প্রতিটা অ্যাক্টিভিটিতে। বছরের অন্যসময় যে কাজ করে উঠতে পারে না, সেসব এখানে করে খুব সহজে।

কীসের এত অমোঘ টান? আমি মনে করি, কংক্রিটের জঙ্গলের বাসিন্দা হলেও অদৃশ্য সুতোয় প্রকৃতি সব মানুষকে টানে। ছোটরা তো প্রকৃতির আরও কাছের। তাই তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে তাদের আনন্দ অফুরন্ত।

নতুন নতুন প্রজাতির পাখি দেখা। তাদের চেনা। তার সম্পর্কে গল্প শোনা। প্রজাপতির ডানায় যে অসংখ্য আঁশ আছে, সেটা জেনে আশ্চর্য হওয়া।  লজ্জাবতীর পাতায় হাত ছোঁয়ালেই যে কাণ্ড ঘটে, তাতে চমকে যাওয়া। বড় একটা গাছের মাত্র পাঁচ ফুট গোলাইতে দশটি আলাদা প্রজাতির পোকামাকড় খুঁজে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া। বড় গাছ শুধু অক্সিজেনের জোগান দেয়, তা নয়। কত যে প্রাণীর খাবার আর বাসস্থান জোগায়, সেই হিসেব রাখে কজন। তারা শেখে- এই পাখি, এই কীটপতঙ্গ বাস্তুতন্ত্রে কী অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। শিবিরের আশপাশে বসবাসকারী জনজাতির সঙ্গে পরিচয় হয় পড়ুয়াদের। তাদের সংস্কৃতি, আচার, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানে।

স্কুলে পরিবেশের পাঠ্যবইতে পড়া নানা বিষয় সহজভাবে হাতে-কলমে উপলব্ধি করা যায় এধরনের শিবিরে। পাঠ্যবই পড়ার মতো বাধ্যতামূলক কোনও ক্লাস নেই। ওরা শেখে খেলতে খেলতে, জঙ্গল-পাহাড়িপথে চলতে চলতে। আনন্দের সঙ্গে। যে শিক্ষাদানের কথা রবীন্দ্রনাথ বারে বারে বলে গিয়েছেন।

আনন্দ আছে বলেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘাম ঝরিয়ে ট্রেকিং, ক্লাইম্বিং করে। কমান্ডো নেটে চড়ে। দড়ি ধরে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে যায়। জল, খাবার প্রকৃতি পাঠ এবং অ্যাডভেঞ্চার শিবিরে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সংস্থা তাদের সামর্থ্যমতো চেষ্টা করে বাচ্চাদের পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার খাওয়ানোর।

অভিভাবক, বিশেষ করে মায়েদের বরাবরের অভিযোগ, তাঁর বাচ্চা এটা খায় না-সেটা খায় না। শিবিরে আসার আগে রীতিমতো লম্বা তালিকা তৈরি করে পাঠান একাংশ। ক্যাম্প ফেরত সেই বাচ্চাটি যখন জানায়, সে ক্যাম্পে সবধরনের খাবার খুব মজা করে খেয়েছে, তখন মা অবাক চোখে শোনেন।

এর পেছনে রয়েছে, প্রকৃতির শিক্ষা। এই ৫-৬ দিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত নয়টা অবধি যে পরিশ্রম হয় বা যত পরিমাণ ক্যালোরি খরচ হচ্ছে, তা বোধহয় বাড়িতে ছয় মাসেও হয় না। তাই এখানে শরীর খাবার চায়। পাশাপাশি রয়েছে পিকনিকের আমেজ। বাকিদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে খোলা আকাশের নীচে জঙ্গল-পাহাড় ঘেরা মাঠে গোল হয়ে বসে খাওয়ায় যে আনন্দ, তা লিখে বোঝানো যাবে না।

খাওয়াদাওয়া শেষে ক্যাম্প ফায়ারের রিহার্সালের গান ধরে ওরা, ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…।’

আগে বহু জায়গায় প্রকৃতি পাঠ শিবির বসত। এখন জায়গার অভাব, অপর্যাপ্ত পানীয় জল, প্রশাসনিক অনুমতির জটিলতা এবং বন্যপ্রাণের আনাগোনার কারণে সংখ্যাটা কমে এসেছে। উত্তরবঙ্গে ওই ধরনের শিবির আয়োজনের অন্যতম জনপ্রিয় জায়গার একটা তালিকা দেওয়া হল-

১) আলিপুরদুয়ার : হাতিপোঁতা, জয়ন্তী, সাতরাবাড়ি ও রায়মাটাং।

২) কালিম্পং : কোপিশ গ্রাম, মৌরে, ঝালং, সামসিং, সুন্দর বস্তি, সাকাম, নোয়াম গ্রাম, পাথরঝোরা, ইয়াংমাকুম এবং লিস নদীর ধার।

৩) উত্তর দিনাজপুর : কুলিক (রায়গঞ্জ)।

৪) দার্জিলিং : বাগোড়া, মঞ্জু, রোহিণী।

জায়গা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন, সেখানে যাতায়াতের সুবিধা, খোলা মাঠ, পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা। যদি খোলা জায়গা না থাকে, তাহলে স্কুল কিংবা কমিউনিটি হল ব্যবহার করা হয়। তবে সেক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচাগার প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, প্রাণী আর গাছগাছালি প্রয়োজন প্রকৃতি পাঠের জন্য। পাহাড়ি অঞ্চল হলে সবচেয়ে ভালো। সেখানে অ্যাডভেঞ্চার অ্যাক্টিভিটি ভালো হয়। নিরাপত্তার দিকটি খেয়াল রাখতে হবে সবার আগে। বন্যপ্রাণের যাতায়াত বেশি, এমন জায়গায় তঁাবু টানিয়ে ক্যাম্প করা উচিত নয়।

শিবির আয়োজনের ক্ষেত্রে এখন বেশ কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সংগঠনগুলোকে। সবথেকে বড় চিন্তার বিষয়, টাকার জোগান। সরকারি তরফে আর্থিক সাহায্য নেই বললেই চলে। আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের কাছ থেকে বেশি ফি নেওয়া সম্ভব নয়। ডোনেশনের ওপর নির্ভর পুরোটা। এছাড়া জায়গার অভাব ভাবাচ্ছে। হোটেল, হোমস্টে, বড় বড় বিল্ডিংয়ে ঢাকছে পাহাড়ি অঞ্চলের আকাশ। অফবিট জায়গায় পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়েছে।

সবশেষে বলা যায়, পাঠ্যবইয়ের বাইরে শেখার সুযোগ প্রচুর। প্রকৃতি থেকে পাওয়া শিক্ষা জীবনে চলার পথে অনুপ্রেরণা জোগায়। কংক্রিটের জঙ্গল থেকে বাইরে বের করে বছরের অন্তত কয়েকটা দিন প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে ছেড়ে দিন বাচ্চাকে। আরও বেশি সংখ্যক স্কুল, সংগঠন এধরনের শিবির আয়োজনে এগিয়ে এলে বেশি পরিমাণে পড়ুয়া অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। হাত বাড়িয়ে দিক প্রশাসনও।

Web Desk
Web Deskhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad is leading online news publisher in West Bengal. Every single article post checked after verify and fact checking by our own staff.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img
[td_block_21 custom_title="LATEST POSTS"]

Most Popular