ভারতীয় রাজনীতিতে ২০২৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সদ্য অতীত বছরটিতে আঞ্চলিক দলগুলি দেশীয় রাজনীতিকে নতুন দিশা দেখিয়েছে৷ লোকসভা সহ বেশ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি, কংগ্রেসের মতো ‘জাতীয়’ দলের আধিপত্যকে তারা শুধু চ্যালেঞ্জই করেনি, আঞ্চলিকতার নিরিখে ও স্থানীয় সমস্যা সমাধানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে৷
লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, তামিলনাডুতে ডিএমকে’র মতো দলগুলি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে। সমাজবাদী পার্টি ৩৭টি, তৃণমূল ২৯টি ও ডিএমকে ২২টি আসনে জয়ী হয়েছে৷ লোকসভার মোট আসনের প্রায় সাড়ে ষোলো শতাংশ আসন তাদের কবজায়।
বিধানসভা নির্বাচনগুলিতেও এই উত্থান অব্যাহত৷ ঝাড়খণ্ডে জেএমএম ৮১ আসনের মধ্যে ৫৬টিতে, অন্ধ্রপ্রদেশে টিডিপি ১০৬টি আসন জিতে ক্ষমতায় ফিরেছে। এই জয় রাজ্যগুলির সমস্যা সমাধান ও নীচুতলার ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগে সাফল্যের কারণে। এতে ভবিষ্যতে ভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলির নীতি নির্ধারণ, শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে আঞ্চলিক দলগুলি শুধু নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেনি, উপরন্তু তৃণমূল স্তরে শাসন, জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ও যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির ওপর ভিত্তি করে নতুন নির্বাচনি ব্যাখ্যাও তৈরি করেছে। এই বদল দেশের রাজনৈতিক ‘ইকো সিস্টেম’-কে নাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২৪ ফের জোট রাজনীতির গুরুত্ব ফিরিয়ে এনেছে।
অন্যদিকে, মেরুকরণে জোর দিয়ে চাপে পড়েছে বিজেপি। ২০১৪ থেকে টানা জয়ী বিজেপি’র জাতীয় শাসনের মডেলের গুরুত্ব ক্রমে ফিকে হচ্ছে। আঞ্চলিক দলগুলি স্থানীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে নয়া দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে। এক্ষেত্রে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক দলগুলির শাসিত রাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতকে গুরুত্ব দেওয়ায় কিছু খামতি আছে।
যদিও সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল, জেএমএম, ডিএমকে’র মতো দলগুলি বিজেপিকে কড়াভাবে মোকাবিলা করেছে। এই বদল ‘ইন্ডিয়া’ জোটে কংগ্রেসকে কৌশল নির্ধারণ ও আঞ্চলিক শরিকদের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বেশকিছু রাজ্যে কংগ্রেসের পতন বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে অক্ষমতাও আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব বাড়িয়েছে। যদিও বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কংগ্রেসকে আরও অনেক কাজ করতে হবে।
যেমন আরও আঞ্চলিক দলকে স্বীকৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণে তাদের বেশি করে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি। এক্ষেত্রে নজির মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপির নেতৃত্বে মহাজোট জাতিগত সত্তা নির্ণয় ও কৃষি দুর্দশা মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছিল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আদলে ‘লাডলি বহিন যোজনা’ মহিলাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা দিয়েছে৷
হরিয়ানায় তেমনই বিজেপির তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার কৃতিত্ব মাইক্রো-ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানের কারণে৷ ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী আবেগ উসকে ও মেরুকরণের প্রয়াসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাফল্য পেয়েছে জেএমএম। তাদের জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ ও শক্তিশালী আদিবাসী পরিচয় ভোটারদের প্রভাবিত করেছে। ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’ ও ‘বিরসা হরিত গ্রাম যোজনা’ প্রকল্পও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
আঞ্চলিক দলগুলির প্রাধান্য মানে পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে রাজ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি। এই দলগুলির উত্থান ভারতীয় রাজনীতিতে বদলের সূচক। অন্যদিকে জাতীয় স্তরের প্রধান দলগুলির আধিপত্য পতনের ইঙ্গিত। সম্প্রতি সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে নানা বিষয়ে বিরোধী ঐক্যে ফাটল স্পষ্ট ছিল। কংগ্রেস যখন আদানি ইস্যুতে সরব হচ্ছে, তখন সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল ছিল অন্য বিষয়ে সোচ্চার৷
বিজেপি আবার ওয়াকফ, এক দেশ-এক ভোট বিল নিয়ে ব্যাকফুটে যেতে বাধ্য হয়েছে। অতীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিজেপি এসবকে গুরুত্ব দিত না। কিন্তু এখন পা ফেলার আগে চন্দ্রবাবু, নীতীশদের কারণে দ্বিতীরবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। এটাই জোট সরকারের বাস্তবতা। এতে সংসদে আঞ্চলিক অগ্রাধিকার প্রণয়ন প্রক্রিয়া আরও সক্রিয় হবে। স্থানীয় সমস্যা অস্বীকার করলে জাতীয় দলগুলি তলিয়ে যাবে। একতরফা নিয়ন্ত্রণের যুগ শেষ। এখন আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে জোট শুধু কৌশল নয়, অপরিহার্যও বটে।