কলাম

দেশে যতই অর্থসংকট থাক, ভোটে লগ্নি অনেক

  • গৌতম সরকার

কয়েন না কর্তা, ঘোড়ায় হাসব। নির্মলা সীতারামনের কথা শুনে হাসি পেতেই পারে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ভাঁড়ারে নাকি প্রবল সংকট। এমন অবস্থা যে ভোটে লড়ার আর্থিক সংস্থান নাকি নেই তাঁর। যদিও পাবলিক ডোমেইনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সম্পত্তির পরিমাণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে এগিয়ে। ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী ২,৬৩,৭৭,৮৬১ টাকা সম্পত্তির মালিক সীতারামন। ২০১৯ সালের হলফনামা অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদির হাতে আছে একটু কম ২,৫১,৩৬,১১৯ টাকার সম্পত্তি।

তাহলে হঠাৎ নির্মলার এই আর্থিক সংকটের যুক্তি নিয়ে চর্চা চলছে। আরও চলবে। কিন্তু জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির এই প্রাক্তনীর কথা আমাকে ৪৬ বছর আগের দুটি ঘটনায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সময়টা ১৯৭৮ সাল। বাংলায় প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। আমার গ্রামের একজন কৃষিজীবীকে গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। তখন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রার্থীর মনোনয়নের ফি ছিল ১০ টাকা। তিনি হাত তুলে দিলেন দলের কাছে। ১০ টাকা দেওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

জেলা পরিষদে যাঁকে প্রার্থী করেছিল সিপিএম, তাঁরও আয়ের মূল উৎস ছিল চাষাবাদ। সঙ্গে জমি মাপার কাজ করতেন। তিনিও মনোনয়নের ১০০ টাকা ফি দিতে অক্ষম বলে জানিয়ে দিলেন। দল তাঁদের সংকট দূর করেছিল। মনোনয়ন ফি কোনও কোনও প্রার্থীকে দিতে হত বটে তখন। তবে প্রচার বা সভার খরচ সাধারণত দলই বহন করত। সব দলই। দশকের পর দশক বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীদের লক্ষ লক্ষ টাকা, গাড়ি ইত্যাদি পাঠাত হাইকমান্ড।

সে সব গাড়ি পরে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হত, টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আকছার উঠত। তবু কার্পণ্য ছিল না কংগ্রেস নেতৃত্বের। নির্বাচন এলে টাকার অপেক্ষায় দিল্লির পথ চেয়ে থাকতেন কংগ্রেস নেতাদের কেউ কেউ। ২০১১ সালে তৃণমূল প্রার্থীদের কলকাতায় ডেকে লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন মুকুল রায়। বিজেপির কোষাগারে আরও বেশি টাকা। কোটি কোটি। নির্বাচনি বন্ডে দলীয় তহবিল কতটা স্ফীত হয়েছে, ইন্টারনেট ঘাঁটলেই এখন জানা যায়।

বিজেপির হাইকমান্ড ভোটে লড়ার টাকা দেয় না, সব রাজ্যের জেলা স্তরে দলীয় কার্যালয় নির্মাণে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। বাংলার বিভিন্ন জেলা সদরে দলের ঝাঁ চকচকে হাইটেক দপ্তর তৈরি হচ্ছে সেই অর্থে। আগের মতো আয়ের উৎস না থাকলেও সিপিএম, এমনকি ফরওয়ার্ড ব্লকের সম্পত্তি কম নয়।

সে যা হোক, ৪৬ বছর আগের কথায় ফিরে আসি। তখন প্রার্থীরা কেউ খরচ নিয়ে ভাবতেন না। লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন। গৌরী সেন অর্থে রাজনৈতিক দল।

বাম দলের প্রার্থীরা কর্মীদের সঙ্গে হাটেঘাটে ঘুরে কৌটো ঝাঁকিয়ে চাঁদা তুলতেন বা পাড়ায় পাড়ায় কুপন দিয়ে অর্থসংগ্রহ করতেন। বড় শিল্পপতিরা দরাজহস্ত ছিলেন কংগ্রেসের তহবিল ভরতে। বদলটা আসতে শুরু করল কমিশন প্রথার হাত ধরে। কাজ যাই হোক না কেন, জনপ্রতিনিধিদের কমিশন দিতে হবে। তৃণমূল জমানায় সেই কমিশন হয়ে গেল কাটমানি। বাম জমানায় প্রধান বা পঞ্চায়েত সদস্য না চাইলেও টেন্ডার মূল্যের ৫ শতাংশ তাঁদের হাতে গুঁজে দিতেন ঠিকাদার, সরবরাহকারীরা।

কেউ নিতে না চাইলে ঠিকাদার বা সরবরাহকারীরা সেই প্রধানের বৌয়ের কাছে পৌঁছে যেতেন। ‘বৌদি এটা রাখুন।’ এটা আসলে অভ্যাস খারাপ করার একরকমের কৌশল। ঘরের লোককে লোভী বানিয়ে দাও। সেই চাপে অসৎ হয়ে যেতে দাও জনপ্রতিনিধিদের। বাম আমলেই কৌশলটা সফল হতে আরম্ভ হল। তারপর স্বেচ্ছায় কমিশনের জমানা পার হয়ে গেল। শুরু হল চাপ দিয়ে টাকা আদায়। কখনো-কখনো দলের নাম করে। দল হয়তো জানতই না।

এখন দল সব জানে। দল ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা সিপিএমের একাংশের ছেঁড়া চটিতে পা গলিয়ে গুরু মারায় বিদ্যায় ওস্তাদ হয়ে উঠলেন। ব্যাপারটা আর পুকুর চুরি থাকল না, হয়ে গেল সমুদ্র চুরি। সুযোগ পেলে বিজেপির জনপ্রতিনিধিরাও যে সুযোগ ছাড়েন না, তার অনেক উদাহরণ আমার সাংবাদিকতা জীবনে দেখেছি। ক্রমশ সামনে আসছে যে, মোটা টাকার নির্বাচনি বন্ড কিনে বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদলের ভাঁড়ার ভরিয়ে বরাত হাতিয়ে নিয়েছে অনেক শিল্পগোষ্ঠী।

গ্রাম স্তরে, বিধানসভা বা লোকসভা কেন্দ্র স্তরে সেরকম গোষ্ঠীর অনেক ক্ষুদ্র অবতার সক্রিয়। তাদের সুবাদে লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছে জনপ্রতিনিধিত্ব। একধরনের লগ্নি হয় এই পেশায়। দলের নেতা বা জনপ্রতিনিধির পদ দখল করাটাই সেই লগ্নি। কেউ আমানত রাখলেই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে মুনাফা। দলের কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য তাই উৎকোচ দেওয়া এখন দস্তুর।

ঠিকাদার-সাপ্লায়ারদের একাংশও লগ্নি করেন জনপ্রতিনিধিদের ওপর। মনোনয়নপত্র পেশ থেকে ভোটের প্রচারের খরচ, জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরেও নানাবিধ জোগান দেওয়া সেই লগ্নির মধ্যে পড়ে। বিনিময়ে জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে সুযোগসুবিধা, বরাত, ব্যবসায়িক লাভ নিংড়ে নেন তাঁরা। কর্পোরেট দুনিয়া, এমনকি স্থানীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী জনপ্রতিনিধিদের ব্যবহার করে ফুলেফেঁপে ওঠে। এখন আর তাই কাউকে বলতে হয় না, মনোনয়ন ফি দেওয়ার টাকা নেই।

ভোটে লড়তে দল যা টাকা দেয়, তার অতিরিক্ত খরচ করার জন্যও এই গৌরী সেনরা মুখিয়ে থাকেন। জনপ্রতিনিধিরাও কয়েকশো গুণ রিটার্ন তুলে নেন। অসমে সম্প্রতি একজন রাজনৈতিক নেতাকে টাকার বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। বাংলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়িতে টাকার পাহাড় উদ্ধার হয়েছে। টাকা মাটি, মাটি টাকা – রামকৃষ্ণদেবের বাণীটা উলটে গিয়েছে যেন।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

VC Recruitment | রাজ্যের পাঠানো উপাচার্যের তালিকাতেই সায় রাজ্যপালের, দূরত্ব কি ঘুচলো দু’য়ের মধ্যে?

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক:  রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ (VC recruitment) নিয়ে রাজ্যপালের (C V Ananda…

16 mins ago

India-US | ইরানের সঙ্গে বন্দর চুক্তিতে ক্ষুব্ধ আমেরিকা, ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইরানের চাবাহার বন্দর (Chabahar Port) নিয়ে চুক্তি করতেই ভারতের উপর ক্ষুব্ধ…

45 mins ago

C V Ananda Bose | আরও বেকায়দায় রাজ্যপাল! নৃত্যশিল্পীকে ধর্ষণের অভিযোগ বোসের বিরুদ্ধে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক:  আবারও শিরোনামে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস (C V Ananda Bose)।…

1 hour ago

Balurghat | ২০ টাকা বাঁচাতে ভরসা সাইকেল, উচ্চমাধ্যমিকে নজরকাড়া সাফল্য বালুরঘাটের মিতালির

বালুরঘাট: অভাবের সংসার। অভাব এতটাই যে ২০ টাকা বাঁচাতে দিনে চারবার সাইকেলে করে যাতায়াত করত…

1 hour ago

কোম্পানি দায়ী নহে, তাহলে দায়ী কে?

  আশিস ঘোষ  ‘মালের দায়িত্ব কোম্পানির নহে।’ ছোটবেলা থেকে বাসের ভিতরে লেখা দেখতাম। সঙ্গে সতর্কবাণী, ‘মাল…

1 hour ago

coal smuggling case | কয়লা পাচার মামলা: সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ লালার, শর্তসাপেক্ষে পেলেন জামিন

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়, আসানসোল: আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালত থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন পেলেন কয়লা পাচার মামলার মূল…

2 hours ago

This website uses cookies.