রুপম দেব
প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে চা শিল্প উত্তরবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। চা শিল্প উত্তরের আর্থসামাজিক বাস্তবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু স্বার্থান্বেষীদের ফাঁদে পড়ে চা শিল্প ধ্বংসের মুখে। দার্জিলিংয়ের চা বাস্তবে ধুঁকছে। সঠিক নীতি এবং মূল্যায়নের অভাব, রাজনৈতিক মুনাফা, নেতাদের অজ্ঞতা নানা কারণে চা বলয়ে ঘনাচ্ছে আশঙ্কার কালো মেঘ। তা সত্ত্বেও হেলদোল নেই কারও। শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন না কেউই।
উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ বন্ধ চা বাগান পুনরায় খোলা হয়েছে। বর্তমানে বড়জোর ৫-৬টি বাগান বন্ধ রয়েছে। এটা প্রচারে এনে শাসকদল নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে ব্যস্ত। বাস্তবে খুলে দেওয়া বাগানগুলোর বহু জায়গায় মাসের পর মাস শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস পিএফ সংক্রান্ত দাবিতে একটি পদযাত্রার আয়োজন করলেও বীরপাড়া-মাদারিহাট ব্লকের হান্টাপাড়া ও ধুমচিপাড়া বাগানে তারা প্রবেশ করেনি। কারণ, এই বাগানগুলিতে বিগত চার মাস ধরে শ্রমিকরা কোনও মজুরি পাচ্ছেন না।
এই অঞ্চলের চা বলয়ে সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। নির্বাচিত বিধায়কের বাড়ি ডিমডিমা বাগান এলাকায়। অথচ সেই বাগানেও শ্রমিকরা প্রায় দুই মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। আশ্চর্যের বিষয়, ওই ব্লকেই শাসক ও বিরোধী দুই পক্ষের সর্বাধিক কেন্দ্রীয় স্তরের চা শ্রমিক নেতা রয়েছেন। অথচ সেখানেই বাগানের সমস্যা সবচেয়ে প্রকট।
রাজ্য সরকার চা বাগান সমস্যার সমাধানে একাধিক কমিটি গঠন করেছে, তৈরি হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর। সেই নীতি অনুসারে, যখন-তখন বাগান বন্ধ করে দেওয়া, মজুরি বকেয়া রাখা, লিজ বাতিল করা যাবে। এই নিয়ম কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। রাজ্যের তৈরি টি অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল আসলে সমস্যার সমাধানে নয়, নেতাদের সরকারি স্টিকার লাগানো গাড়িতে ঘোরাঘুরির সুবিধা দিতেই তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য আবার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হবে। কিন্তু গত সাত বছরে কুড়ি বারেরও বেশি বৈঠক করার পরেও যখন ফল মেলেনি, তখন আরেকটি কমিটির প্রতিশ্রুতি নতুন প্রতারণারই নামান্তর।
প্রকৃত সমস্যা হল, চা বলয়ে কার্যকর কোনও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি নেই। সিপিএম তাদের শাসনকালে শ্রমিকদের প্রতি যে অবিচার করেছে, তার জন্য এখনও ক্ষমা চাইতে সাহস পাচ্ছে না। অন্যদিকে বিজেপি, অসমে যারা এখনও মজুরি সীমাবদ্ধ রেখেছে ২২৫–২৫০ টাকার মধ্যে, তারাও জমির মালিকানা বা উপজাতীয় স্বীকৃতির দাবিতে কোনও জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে তাদের নেতারাও চা বলয়ে আস্থা তৈরি করতে পারছেন না। বরং পদ হারালেই এক দল থেকে আরেক দলে যাওয়া তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কলকাতাকেন্দ্রিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের প্রতি অনুগত উত্তরবঙ্গের নেতারা আজ পর্যন্ত চা বাগানের জন্য কোনও স্পষ্ট বিকল্প নীতির সন্ধান দিতে পারেননি। সমবায়ের মাধ্যমে বাগান পরিচালনার প্রশ্ন উঠলেই তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ২০২৩ সালে হঠাৎই রাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, চা বাগানের শ্রমিকদের জমির পাট্টা দেওয়া হবে। অথচ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শ্রমিকদের মতামত নেওয়া তো দূরের কথা, কোন জমিতে পাট্টা দেওয়া হবে, সেই জমির চরিত্র কী, এই পাট্টা কী সুবিধা দেবে, এসব নিয়ে কোনও স্বচ্ছতা নেই। নেতা ও প্রশাসনের মনোভাব এমন, ‘এতদিন কেউ কিছু করেনি, আমরা তো করছি, এবার আর প্রশ্ন তুলো না।’
চা শিল্পের প্রকৃত চিত্র বোঝার জন্য শুধু রাজনৈতিক দিক নয়, অর্থনৈতিক কাঠামোর বিশ্লেষণও জরুরি। চায়ের একটি বড় অংশ অকশন ছাড়াই সরাসরি বিক্রি হয়ে যায়, যার কোনও হিসেব সাধারণ মানুষের কাছে নেই। মালিকপক্ষ সাধারণত অকশনে কম দাম দেখিয়ে চা শিল্পের সংকটের গল্প ফাঁদে। ফলে একটি বিশাল অঘোষিত অর্থপ্রবাহ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়। চা শিল্পে এই প্রক্রিয়া বহু আগেই শুরু হয়েছিল। কলকাতা, দিল্লি ও গুয়াহাটির প্রভাবশালী লবি আজ বাংলা ও অসমের চা শিল্প নিয়ন্ত্রণ করে। দুই রাজ্যে সরকার ভিন্ন হলেও মজুরি বৃদ্ধির হার প্রায় সমান, যাতে কোনও এক রাজ্যের শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে অন্য রাজ্যে শ্রমিক বিক্ষোভ তৈরি না হয়। এটা হয়তো একধরনের সমঝোতা। তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে চা বলয়ে রাজনৈতিক বিপর্যয় আসতে পেরে জেনেও যখন বাংলায় টি ট্যুরিজমের নামে চা বাগানের তিরিশ শতাংশ জমি বরাদ্দ করে দেওয়া হয় তা দেখে। অসমেও কর্পোরেট স্বার্থে শ্রমিক উচ্ছেদ করে একই কাজ করা হচ্ছে।
রাজ্য সরকার দাবি করেছে, চা পর্যটনে আশি শতাংশ স্থানীয় মানুষ কর্মসংস্থান পাবেন। তবে বাস্তবটা ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, শিলিগুড়ি শহরের পাশের একটি চা বাগানে গড়ে ওঠা একটি রিসর্টে ‘কলোনিয়াল সুইট’-এর এক রাতের ভাড়া দিয়ে দশজন শ্রমিককে এক মাস বেতন দেওয়া যায়। কিন্তু সেখানে ক’জন স্থানীয় মানুষ কাজ পেয়েছেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আসলে চা শিল্পের বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে আজও রয়ে গিয়েছে এক দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণের পরম্পরা। উত্তরবঙ্গের অনুন্নয়ন এবং শ্রমিক জীবনের অবমাননার মূল শিকড় আজও গেঁথে রয়েছে ১৫০ বছরের চা শিল্প ব্যবস্থার গভীরে।
লেখক-সমাজকর্মী