শেখর বসু
চোখ কান নাক দিয়ে শিকাগো শহরকে কিছুক্ষণ গ্রহণ করলাম। তারপর পকেট থেকে হোটেলের ঠিকানা-লেখা কাগজটা বের করেছিলাম। হোটেলে আমার রুম বুক করা আছে। আর এটাও জানি, হোটেলটা শিকাগো শহরের কাছাকাছি।
পথচলতি এক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তাটা কোথায় হবে বলতে পারেন? উনি বললেন, এই তো সামনেই, একটুখানি সোজা গিয়ে ডানদিকে যান।
বাহ! ভাসতে ভাসতে তো ঠিক পথেই এসে গিয়েছি। তবে উলটো পথ হলেও আফসোসের কিছু থাকত না। শহরের এই সকালটা বোধহয় ভেসে বেড়াবার পক্ষে আদর্শ।
ডানদিকে ঘুরতেই পেয়ে গেলাম ওয়েস্ট অ্যাডামস স্ট্রিট। এই রাস্তার ওপরেই আমার হোটেল ‘ক্লাব কোয়ার্টার্স’। হোটেল খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগে না। হাসিমুখের রূপসি শ্বেতাঙ্গিনী চটপট চেক-ইনের ব্যবস্থা করে হাতে ম্যাগনেটিক কার্ড ধরিয়ে দিলেন। ঘরের চাবির বদলে এই কার্ড ব্যবহার করতে হয়। এটা আমার জানা ছিল। কিন্তু যা জানা ছিল না, তা জানতে পারলাম একটু বাদে।
এগারোতলায় বরাদ্দ হয়েছে আমার ঘর। মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওদিকের লিফটে গিয়ে উঠলাম। ঝকঝকে তকতকে বিশাল লিফট। দশ নম্বর ফ্লোরের বোতাম টিপলাম, কিন্তু লিফট একটুও নড়াচড়া করল না। কী ব্যাপার! খারাপ নাকি! আরও দু’চারটে বোতাম টিপলাম, কিন্তু লিফট আগের মতোই নিথর।
রিসেপশনে এসে বললাম, লিফট তো চলছে না। আমার অসুবিধেটা ঠিক কোথায়— বুঝতে পেরেছিলেন ভদ্রমহিলা। বললেন, বাটনবোর্ডে কার্ড সোয়াইপ করুন, তারপর বাটন প্রেস করুন।
ফিরে এসে হাতের ম্যাগনেটিক কার্ড খাঁজের মধ্যে একবার টেনে বোতাম চাপ দিতেই নিথর লিফট প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম এগারোতলায়।
হোটেলের এগারোতলায় লম্বা করিডর। দু’পাশে পরপর অনেকগুলো রুম। পায়ের নীচে পুরু কার্পেট। কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। যেন নিঝুম পুরী। রুম খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছুটা হাঁটতে হয়েছিল, কিন্তু কোথাও একটা মানুষেরও দেখা নেই। করিডরে দুটো বাঁক ঘোরার পর রুমের দেখা পেলাম। ম্যাগনেটিক কার্ড দরজায় লাগানো নির্দিষ্ট খাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে টানতেই ঘরের দরজা খুলে গিয়েছিল।
ঘর সাজানো গোছানো, ঝকঝকে তকতকে। দেওয়ালে গোটাতিনেক আলো। একধারে একটা রাইটিং টেবিল আর চেয়ার। ডেবিলে বাহারি ল্যাম্প। পাশে টেলিফোন, রাইটিং প্যাড আর পেন। ওদিকে টিভি সেট। বিশাল গদিআঁটা খাট। বিছানার ধবধবে সাদা বেডশিট, মাথার দিকে বালিশ, পায়ের কাছে ভাঁজ করা কম্বল।
লাগোয়া বাথরুমটাও পরিচ্ছন্ন। ওয়াশ বেসিন, পেছনে মস্ত আয়না, ওদিকে বাথটাব। ঘরটা বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল আমার। দেওয়ালে একগুচ্ছ বেগুনি ফুলের পেন্টিং। ওদিকে দেওয়ালজোড়া জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে একবার উঁকি মারলাম। উঁকি মারতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শরীরে। আমি এখন এগারোতলায়, কিন্তু এগারোতলাকে এর আগে আর কখনও এত নীচু বলে মনে হয়নি। এই হোটেলটা ক’তলার তখনও জানি না, কিন্তু প্রতিবেশী বাড়িগুলো সটান আকাশে উঠে গিয়েছে। বিস্তর কসরত করার পরে দেখলাম, বাড়িগুলো কমপক্ষে পঞ্চাশ-ষাটতলা। পাথুরে চেহারার মজবুত গড়ন স্কাইস্ক্র্যাপার।
পর্দা সরানো জানলা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছিল ঘরের মধ্যে। উজ্জ্বল হলুদ রোদ, তবে মাত্রই একফালি। বহুতলের দেশে এখানে সব ঘরে রোদ ছড়িয়ে পড়ার উপায় নেই। দু’একফালি রোদই বোধহয় অনেকখানি। ওই রোদের দিকে তািকয়ে থাকতে থাকতে মাথার মধ্যে জমানো কিছু তথ্য নড়েচড়ে উঠেছিল আবার।
শহরের আদিযুগে নিতান্তই ভৌগোলিক কারণে নানারকম অসুবিধের মধ্যে ছিল শিকাগো। এলাকাটির চরিত্র ছিল তৃণভূমি অঞ্চলের মতো। নরম জমি, তার ওপর ছিল পোকামাকড়ের উৎপাত। নীচু এলাকাগুলো বসন্তকালে জলে ডুবে থাকত প্রায়ই। রাস্তা কাদায় ভরে যেত। কোথাও কোথাও ঘোড়ার পায়ের পুরোটাই ডুবে যেত। শহরবাসীরা মজা করে রাস্তার নাম দিয়েছিল ‘অতল পথ’। শুধু একটাই নয়, নানা ধরনের নাম ছিল। একটা যেমন— ‘চিনদেশে যাওয়ার দ্রুততম পথ।’
ঢেলে সাজানো হয়েছিল শহরের পয়ঃপ্রণালী। কিন্তু সব সমস্যা দূর হয়নি তাতে। নীচু এলাকা আগের মতোই নদীর জলে ভাসত। এর কবল থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শিকাগো সিটি কাউন্সিল অসম্ভব এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। গোটা এলাকাটাই চার-পাঁচ ফুট উঁচু করে তোলা হবে। কিন্তু কীভাবে? নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল তখন— জ্যাকিং আপ প্রসেস। ওই পদ্ধতির প্রয়োগে অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছিল।
পাঁচতলা একটা হোটেল ছিল, যার মোট ওজন বাইশ হাজার টন, ওই হোটেলটিকে চালু অবস্থায় রেখেই ওপরদিকে ঠেলে তোলা হয়েছিল। অমন কাণ্ড সেই সময় ইউরোপেও অকল্পনীয় ছিল। প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক পল জনসন ওই দৃষ্টান্তটির উল্লেখ করে বলেছিলেন— মার্কিনিদের মনের জোর এমনই যে, এরা বোধহয় যা চায় তাই-ই করতে পারে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে বিরাট এক অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে পড়েছিল শিকাগো শহর। আঠারো হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মারা গিয়েছিল তিনশোজন। গৃহহারা হয়েছিল শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। অর্থাৎ মোট তিন লাখ বাসিন্দার মধ্যে এক লাখ।
আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার একটা বড় কারণ— সর্বত্রই কাঠ। রাস্তা কাঠের, ফুটপাথ কাঠের বেশিরভাগ বাড়িঘরও কাঠের। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়তে না হয় তার জন্যে নতুন একটা আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এবার আর আগের মতো কাঠ নয়, ইট-পাথরের ইমারত বানানোর দিকে ঝোঁক দেওয়া হবে। রাস্তা, ফুটপাথ, বাড়িঘর বানানোর কাজে কাঠ বাদ পড়বে যথাসম্ভব।
কিন্তু লেকের ধারের জমি যে বড্ড নরম। ওই জমি বেশি পরিমাণ ইট-পাথরের চাপ নেবে কীভাবে? আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল মার্কিনি মস্তিষ্ক। ভারী ইট-পাথর ধরে রাখার জন্য আবিষ্কৃত হল স্টিল ফ্রেম এবং ওই পথেই গড়ে উঠল একের পর এক স্কাইস্ক্র্যাপার। স্থাপত্যবিদ্যার নতুন এই সংযোজনের কৃতিত্ব শিকাগোর। আকাশচুম্বী বাড়িকে আশ্রয় করে দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠেছিল শহরের জনসংখ্যা।
ঘরের মধ্যে আসা দুর্লভ ওই রোদের ফালি আরেকটু ঘুরতেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলাম। আমার ব্যাগে ছোট্ট মতো একটা হাতব্যাগ আছে। তার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, টাকাপয়সা আর পাসপোর্ট। ব্যাগটা বের করলাম। আর বের করলাম ক্যামেরা। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।
ঘরের দরজা বন্ধ করে এলিভেটরে চেপে নেমে এলাম একতলায়, তারপরে লম্বা পায়ে রাস্তায়। হোটেলের সামনের রাস্তাটা বিশাল, দু’দিকে সোজা চলে গিয়েছে অনেকখানি। রাস্তার দু’ধারে কংক্রিটে বাঁধানো সাইডওয়াকগুলো বেশ চওড়া, ছোটখাটো রাস্তার মতো। ধারে ধারে মস্ত লম্বা লাইটপোস্ট। ফুটপাথের ভিড় কমে গিয়েছে বেশ। একটু আগের সেই দ্রুতগামী মানুষগুলো বোধহয় ইতিমধ্যে কর্মস্থলে পৌঁছে গিয়েছে। তবে রাস্তায় গাড়ির সারি আগের মতোই। চওড়া রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, কিন্তু শামুকের গতি কোথাও নেই। সব সাঁ-সাঁ করে ছুটছে।
অধিকাংশ গাড়িই বিরাট চেহারার। বিরাট চেহারার ওই মানুষগুলো ছোট গাড়িতে আঁটা কঠিন। সব গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল আবার বাঁদিকে। মার্কিনরা নিজেদের গাড়ি নিজেরাই চালায়। বেশিরভাগ গাড়িতে চালকই একমাত্র যাত্রী। কায়িক পরিশ্রমে আমেরিকানদের বিন্দুমাত্র অনীহা নেই। প্রচুর পয়সাকড়ি থাকলেও বািড়ঘরের সব কাজকর্ম নিজেরাই সারে। রান্নাবান্না, ঘরদোর সাফসুতরো, নির্দিষ্ট স্থানে পলিপ্যাকে মোড়া আবর্জনা রেখে আসা— সব। আবর্জনা তোলার গািড় এসে ওগুলো তুলে নিয়ে যায়।
ঘরদোর শুধু সাফসুফ করাই নয়, অন্যান্য কাজেও এদের বেশ মুনশিয়ানা আছে। এই সব কাজের মধ্যে পড়ে বাড়ির জানলা-দরজা ও দেওয়াল রং করা। কাজ চালাবার মতো প্লাম্বিং ও ছুতোর মিস্ত্রির কাজও এদের জানা আছে। পাঁচটা কাজের দিনের সঙ্গে দুটো করে ছুটির দিন। দুটো দিনের একটা দিন ওরা ঘরসংসারের নানান কাজকর্ম সারে। কাজ এবং জীবন উপভোগ— দুটোই এদের পাল্লা দিয়ে চলে।
আমার এবার গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা দেবার পালা। সিয়ার্স টাওয়ার স্কাইডেক। খুব একটা দূরে নয়। সকাল এগারোটা। বাতাসে হালকা শীত। দু’পাশে স্কাইস্ক্র্যাপার। সেই রোদের কোনও চিহ্ন নেই এখানে। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই এসে গেল ওয়াকার ড্রাইভ। এখানে কাউকে বলে দেওয়ার দরকার নেই কোনটা সিয়ার্স টাওয়ার। ওই তো সেই ভুবনবিখ্যাত টাওয়ারটি। ঘাড় ঘোরাতে ঘোরাতে প্রায় চিৎ হয়ে পড়ার দশা হয়েছিল, তবু টাওয়ারের মাথা দেখা গেল না। গোটা আমেরিকার উচ্চতম অট্টালিকা। সেই সময় একশো আটতলা বাড়ি। উচ্চতা প্রায় দেড় হাজার ফিট। পৃথিবীতে যে গুটিকয় লম্বা বাড়ি আছে, তাদের মধ্যে সিয়ার্স টাওয়ার একটি।
সিয়ার্স টাওয়ারের ওপরে ওঠার জন্যে একশো চারটি এলিভেটর ছিল, এর মধ্যে ষোলোটি ডাবল ডেকার। স্কাইডেক পর্যবেক্ষণ ডেকটি আছে একশো তিনতলায়। দুটি বিশেষ গতিসম্পন্ন এলিভেটরের যে কোনও একটিতে উঠে পড়লে একশো তিনতলায় পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে বলুন তো?
মাত্র ষাট সেকেন্ড। অর্থাৎ এক মিনিট। কানে একটু তালা লাগতে পারে, কিন্তু সেটা ভালোভাবে বোঝার আগেই একশো তিনতলার পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। এখানে যা অপেক্ষা করছে, তাকে শুধুমাত্র ‘বিস্ময়’ বলাটাই যথেষ্ট নয়। সে যাই হোক, সিয়ার্স টাওয়ার নাম পালটে হয়েছে উইলিস টাওয়ার। কিন্তু পুরোনো নামটা কেউ ভুলতে পারেনি।
স্কাইডেক পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে মস্ত একটি পরিবর্তন হয়েছিল সে সময়। আগাগোড়া কাচের তৈরি বড়সড়ো একটি ব্যালকনি। কংক্রিটের কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসেছে ফুটচারেকের একটা কাচের ব্যালকনি। ওখানে দাঁড়ালে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। মনে হবে, একশো তিনতলা থেকে বেরিয়ে এসে শূন্যে দাঁঁড়িয়ে আছি। পায়ের নীচে স্বচ্ছ কাচ। প্রায় এক হাজার চারশো ফুট নীচে শিকাগো শহরের রাস্তা। মনে হবে, শূন্যে ভাসছি।