- লীনা গঙ্গোপাধ্যায়
ঝকঝকে নির্মেঘ আকাশ, বসন্তের মন প্রাণ উথাল করা ফাগুনবাতাস, মুহুর্মুহু কোকিলের ডাকে যেন ভালোবাসার মাসকে বরণ করে নেওয়ার আকুল আহ্বান। ফাল্গুন যেমন সাধারণ মানুষের উৎসবের মাস, এ মাস তেমন চিরকালীন ভালোবাসার প্রতীক রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন ভালোবাসার উদযাপনের মাস। এই দুটি চরিত্র নিয়ে যুগে যুগে, কালে কালে অনেক গল্প কথা মানুষের মুখে ফেরে। এতরকম গল্পে স্বভাবতই ঢুকে যায় নানা স্ববিরোধিতা।
ভালোবাসার মসৃণ মন কেমন করা গল্প ছাড়িয়ে কিছু কিছু প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়ায়, যা শুধু প্রেমকাহিনী বা অপার ভক্তিরস দিয়ে থামিয়ে রাখা যায় না।
সাধারণ মানুষের জীবনে প্রেম স্বল্পায়ু। মানুষ শুধু ভালোবাসায় বাঁচে না। প্রেম জীবনে কখনো-কখনো জোয়ারের মতো আসে। তাতে ভেসে যায় দুটি জীবন। কিন্তু দেবতার প্রেম তো তেমন হতে পারে না। জীবন ছাড়িয়ে মহাজীবনে পৌঁছানোর মতো তাঁদের প্রেম এমন এক প্রতীকে পৌঁছে দেওয়া হয় যার কাছে মানুষ বারবার মাথা নত করে।
রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনীও তেমনই। আমাদের সাধারণ জীবনের মতো তাকে দেখতে চাইলেও গল্পের ছত্রে ছত্রে রয়ে গিয়েছে এক দার্শনিক ব্যাখ্যা।
রাধাকৃষ্ণের মহাজীবন যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই পুরুষ। তাঁরা তাঁদের মনের আলোয় অথবা তাঁদের ধারণা ও বিশ্বাসে স্থিত থেকে লিখেছেন। তাঁরা একটি নারীকে যে চোখে দেখেন, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন। ঠিক একইভাবে সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকেই উঠে এসেছে তাঁদের কলমে কৃষ্ণের চরিত্র।
আসলে কেউ তো নারী হয়ে জন্ম নেয় না। এই সমাজে জন্ম নিয়ে নারী হয়ে ওঠে। তাই এমনকি রবি ঠাকুরকেও লিখতে হয়, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি’। কুসংস্কারের বিজ্ঞানসম্মত রূপ দিয়েছেন আরেক খ্যাতিমান পুরুষ সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনি বারবার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, জন্ম থেকেই নারী একটি প্রত্যঙ্গ হারিয়ে ফেলেছে। তাই তার পক্ষে সম্পূর্ণ মানুষ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
এসব ভাবনার সওয়ারি হয়ে ইন্টারনেটে সেদিন খুঁজছিলাম, শুধুই রাধার নামে ক’টা মন্দির রয়েছে সারা ভারতে? যেখানে বিগ্রহ হিসেবে শুধু থাকবেন রাধা। আর কেউ নন।
দেখি, দেশজুড়ে শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য মন্দির। রাধা থাকলেও, সবই রাধাকৃষ্ণের যুগ্ম মন্দির। কৃষ্ণর হাত ধরে সেখানে হাজির রাধা। মুম্বইয়ে শ্রীরাধা মন্দির রয়েছে, হায়দরাবাদে রাধা মন্দির। সর্বত্র কৃষ্ণ আছেন। ভালোবাসা, ত্যাগ, তিতিক্ষায় জগতের আদর্শ নারীর নামে শুধু একটি মন্দির, মাত্র একটিই। এবং সেটা তাঁর জন্মস্থানে। মথুরা থেকে সামান্য দূরে বারসানায়।
সেখানেও মজা কী জানেন? নাম রাধারানি মন্দির। অথচ সেখানে রাধার পাশে কৃষ্ণ রয়েছেন। রাধাষ্টমীতে পর্বতের চূড়োয় সে মন্দিরে জনস্রোত। তবু শুধু রাধার বিগ্রহ নিয়ে মন্দির সম্পূর্ণ নয়। যতই আমরা ‘রাধে রাধে’ বলি। যতই ‘রাধেকৃষ্ণ’ বলে আগে সম্মান দিই রাধাকে।
সীতার বেলাতেও তো একই ছবি! মন্দিরে মন্দিরে, পথেঘাটে আমরা বলি ‘সীতারাম, সীতারাম’। অথচ রাম মন্দির, রাম-সীতা মন্দিরের ছড়াছড়ির মধ্যে সীতার একক মন্দির খুঁজতে গিয়ে সমস্যা। রাধাকে যেমন মনে রেখেছে তাঁর জন্মস্থান উত্তরপ্রদেশের বারসানা, সীতাকে মনে রেখেছে তাঁর জন্মস্থান বিহারের সীতামারি। সেখানেই নাকি তাঁর পাতালপ্রবেশ–ওই জায়গায় সীতা সমাহিতস্থল। আর একটি রয়েছে জানকী মন্দির। সেখানেও রাম রয়েছেন কিন্তু।
রাধা এবং সীতা– দুজনকেই দুঃখ বা অপবাদের আগুনে পুড়িয়ে শেষপর্যন্ত কোথাও তাঁদের রক্তমাংস থেকে উত্তীর্ণ করা হয়েছে অলৌকিক, অতীন্দ্রিয়তায়! তাতে তাঁদের নিজস্ব মহিমার থেকে বড় হয়ে উঠেছে অন্য দুটি নাম। যে নাম দুটির সঙ্গে তাঁরা জড়িয়ে। এঁদের সঙ্গে কৃষ্ণ ও রাম নাম দুটি জড়িয়ে না থাকলে, বলা কঠিন, এই প্রতিফলিত রশ্মিরেখা রাধা-সীতার কপালে জুটত কি না!
শেষপর্যন্ত অবশ্য দুই নারী অনন্ত নক্ষত্রবীথি। অন্ধকারে যাঁর পবিত্র শিখা জ্বলে! তাই এঁদের উপেক্ষার কথা, অসম্মানের কথা চিরকাল ধর্মের নানা ব্যাখ্যায় ঢাকা পড়ে যায়। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা।
কথিত আছে, রাধারানির জন্ম শ্রীকৃষ্ণের আগে। দেবলোকের বিষ্ণু তখনও মর্ত্যে আসার জন্য তৈরি ছিলেন না। তাই লক্ষ্মীরূপী রাধিকাকে আগে জন্ম নিতে হয়। তবে এ তো ঘোর অনাচার। স্বামীর আগে স্ত্রী জন্ম নিলে, তিনি আগে আগে জগৎ দেখলে স্বামী ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব খর্ব হয়ে যেতে পারে! তাই এক সমাধানসূত্র বেরোয়। শ্রীরাধিকা জন্ম নেবেন আগে, কিন্তু চোখ খুলবেন না। অন্ধ হয়ে জন্মাবেন। যখন শ্রীকৃষ্ণ এই ধরাধামে জন্মাবেন, তখনই রাধা দৃষ্টি পাবেন। অর্থাৎ, ‘তুমি ছাড়া আর এ জীবনে/মোর কেহ নাই কিছু নাই গো…’
বাংলায় রাধাকে নিয়ে যে গল্প প্রচলিত, তাতে রাধা আসলে আয়ান ঘোষ নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী। ঘোর সংসারী। গৃহকর্মনিপুণা। এহেন রাধা গোপিনীদের সংসারের অবসরে এদিক ওদিক গেলে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয় এবং গভীর ভালোবাসায় পড়েন তাঁরা দুজন। যদিও সেই ভালোবাসার পবিত্রতা বা বিশ্বস্ততা রক্ষার দায় কৃষ্ণের নেই। রাধার কুঞ্জবনে আসার পথে তাঁরই বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হলে তাঁর ভেতরে কামভাব জেগে ওঠে।
এদিকে গোটা রাতের অপেক্ষা এবং বিরহে ছটফট করছেন রাধা। রাতভর অপেক্ষার পর যখন তিনি তাঁর প্রাণের মানুষটিকে দেখতে পেলেন, তখন দেখলেন তাঁর শরীরময় রতিচিহ্ন। অভিমানে মুখ ফেরালেন রাধিকা। তখন ছলাকলায়, এমনকি যোগী সেজে কৃষ্ণ আয়ান ঘোষের বাড়ি ভিক্ষা করতে গেলেন। রাধা তাঁকে দেখলেন এবং তাঁর অভিমান বরফ গলা জলের মতো তাঁকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিল।
এও কথিত, শ্রীকৃষ্ণর আটটি বিয়ে। সন্তানসন্ততিও অনেক। স্ত্রীদের মধ্যে প্রধান রুক্মিণী দেবী। শ্রীকৃষ্ণের ভরাসংসার। জীবনের অন্য মানে খুঁজে পেয়েছেন তিনি ততদিনে। অনেক বড় কর্মকাণ্ডে ঢেকে গিয়েছেন তিনি। জগৎকে উদ্ধার করা তো কম বড় কাজ নয়! এদিকে, রাধার সংসার সম্মান সব চলে গিয়েছে। তিনি শুধু অপেক্ষায়। তাঁর প্রাণ যাঁর জন্য ধারণ করে আছেন, তাঁকে দেখার প্রত্যাশায়। শ্রীকৃষ্ণের এখন সময় কোথায়! একটি মেয়ের অপেক্ষা তাঁর চোখের জলের থেকে অনেক বড় তাঁর কর্মজীবন। অনেক বিস্তৃত। অনেক পরিব্যাপী। ওই মেয়েটির চোখের জল তাঁর কাছে তাই বাষ্প হয়ে উবে যেতে সময় লাগে না!
প্রশ্ন জাগে, মনে এতই যখন ভালোবাসা ছিল, তখন তিনি রাধাকে বিয়ে না করে অন্যদের বিয়ে করলেন কী করে! রাধাকে কি তিনি বিয়ের জন্য যথেষ্ট যোগ্য মনে করেননি? এর উত্তর মেলে কিছু বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। তাঁরা দাবি করেছেন, আসলে রাধাকৃষ্ণ দুজন মানুষ হলেও তাঁদের আত্মা একটি। তাঁদের আলাদা করে লৌকিক জীবনের দরকার হয়নি।
অবধারিত প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, তাই-ই যদি হয়, তাহলে শ্রীরাধিকা কি তা জানতেন না? তাহলে তিনি সারাজীবন এই বিরহযন্ত্রণা ভোগ করলেন কেন! তাঁর নামের পাশে কলঙ্কিনী শব্দবন্ধটি খোদাই হয়ে আছে চিরকালের মতো! শ্রীকৃষ্ণ যা করেছেন, তা তাঁর লীলা! শুধুমাত্র পুরুষের চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে বলেই কি এই অসম্মান?
বারবার তাই মনে হয়, জীবনব্যাপী এক অসম ভালোবাসার লড়াই, সামাজিক অসম্মান, নিবিড় উপেক্ষাই পাওনা ছিল শুধু! তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না!
উর্দুতেও কৃষ্ণকে নিয়ে কত বিখ্যাত লাইন! সাহির লুধিনায়নভি যেমন লিখেছেন, ‘কৃষ্ণ নে ওয়াদা কিয়া থা কে ও ফির আয়েগে’। বেকাল উতসাহির মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী কবি লিখেছেন, ‘আমাকে তোমার বাঁশির মতো কলম দাও, কানাইয়া।’ তবে সেখানেও অন্য কবিদের ভাবনায় রাধার উপস্থিতি কম।
ভেবে দেখুন, রাধার মৃত্যু নিয়েও কত মর্মান্তিক উপকথা! রাধা অসুস্থ। মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। শেষ আকাঙ্ক্ষা শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুর শুনতে শুনতে প্রাণবিসর্জন দেবেন!
মৃত্যুপথযাত্রী রাধিকা অপেক্ষায়। খবর পৌঁছেছে কৃষ্ণের কাছে। অসীম ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে এসেছেন শ্রীকৃষ্ণ, রাধার শেষ ইচ্ছে রাখতে। শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছেন। শ্রীরাধিকার দু’চোখে জলের ধারা। আসন্ন চিরবিচ্ছেদ ব্যথায় তাঁর হৃদয় উথালপাতাল। তবু সান্ত্বনা, তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। এভাবেই তাঁর অবিশ্বস্ত প্রেমিকের বাঁশির সুর শুনতে শুনতে একসময় নিথর হয়ে গেলেন রাধা। শ্রীকৃষ্ণ বাঁশিটি ভেঙে ফেললেন।
পণ্ডিতেরা ব্যাখ্যা করেছেন, এরপর শ্রীকৃষ্ণের আর বাঁশি বাজানোর প্রয়োজন ছিল না। কারণ এক আত্মা, এক প্রাণ তাঁরা। তাঁদের এক অংশ বিদায় নিয়েছে! আর কার জন্যই বা বাঁশি বাজাবেন তিনি?
আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের মনে অন্য কথা তোলপাড় করে। একমাত্র বাঁশির সুর অবিচ্ছেদ্য ছিল তাঁদের সম্পর্কে। রাধা সব অভিমান ভুলে যেতেন কৃষ্ণের বাঁশির সুরে। তাঁর হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা কিংবা আত্মার অংশের জন্য এইটুকু স্মৃতিচিহ্ন কি কৃষ্ণ তাঁর শত ব্যস্ততায় রেখে দিতে পারতেন না? হতেই তো পারত, তাঁর ভালোবাসার মানুষ চলে গেলেন। অথচ একজন পাগলপারা প্রেমিক তাঁর বাঁশির সুরটি রেখে গেলেন এই পৃথিবীর বুকে।
অনেকে বলেন, বৃন্দাবনের নিধুবনে রাধাকৃষ্ণ রোজ রাতে লীলাখেলা করতে আসেন। তাই সন্ধের পর ওখানে মানুষের যাওয়া বারণ। কেউ তাঁদের লীলাখেলার সাক্ষী হয়ে গেলে জীবন পর্যন্ত চলে যেতে পারে!
এমনও তো হতে পারত, কখনো-কখনো শ্রীকৃষ্ণের রাধার বিরহে উথালপাতাল হৃদয়ে বাঁশির কষ্ট ফুল ঝরে পড়ত। দূর থেকে ওই ভেসে আসা বাঁশির সুরে আমরা এক সাধিকা রাধাকে অনুমান করতে পারতাম এবং আপনা থেকেই দুটি হাত কপালে জড়ো হত!
(লেখক সাহিত্যিক ও পরিচালক)