গৌতম সরকার
নয়ের দশকের শেষ দিকটা হবে। উত্তরবঙ্গে তখন কামতাপুরি আন্দোলন তীব্র। কেএলও’র বীজ পোঁতা হচ্ছে সদ্য। সেই আন্দোলনের অন্যতম আঁতুড় ছিল অসম সীমানার কুমারগ্রাম। ফলে সংবাদমাধ্যমের নজর তখন আলিপুরদুয়ার জেলার (তখন অবশ্য অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলা) ওই প্রান্তিক জনপদটির দিকে। কলকাতার এক সাংবাদিক আলিপুরদুয়ারে এসে আমাকে বললেন সেখানে নিয়ে যেতে। অনুন্নয়নের বীভৎস ছবি চারদিকে। নদীর ওপর ব্রিজ হয়েছে, কিন্তু তার অ্যাপ্রোচ রোড নেই। হনুমানের মতো বেয়ে বেয়ে ব্রিজে উঠতে হয়, নামতে হয়।
ওভাবে নদী পার হয়ে বিধ্বস্ত সেই সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এখানকার লোকেরা বন্দুক হাতে নেয় না কেন বলো তো! হেসে বলেছিলাম, সর্বংসহা উত্তরবঙ্গ। দুঃখকে আপন করে বেঁচে থাকা এখানকার স্বভাব। সরল মানুষ, প্রতিবাদহীন জীবনযাত্রা। সেই উত্তরবঙ্গটা কিন্তু আর নেই। বরং উত্তরবঙ্গ এখন নানা অস্বাভাবিক কাজকর্মের আঁতুড়।
ঠিক এই মুহূর্তে রাজ্য তোলপাড় ট্যাব কেলেঙ্কারি নিয়ে। ট্যাব কেনার বরাদ্দ পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে জমা না পড়ে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে। এই যে জালিয়াতির জাল ফাঁদা ভুবনে, তার ভরকেন্দ্র নাকি সেই সরল, সাধারণ উত্তরবঙ্গ! উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া ব্লক নাকি যত নষ্টের গোড়া। সেখান থেকে চক্রের অপারেশন। মূল মাথারা নাকি চোপড়ার বাসিন্দা।
তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের চোপড়ায় এখন নাকি উত্তরের জামতাড়া গ্যাংয়ের ডেরা। সেই সরল জীবনযাত্রার উত্তরবঙ্গজুড়ে এখন শুধুই অপরাধ! উত্তরে তোর্ষা থেকে দক্ষিণে ফুলহর- বিস্তীর্ণ ভূভাগে রোজ কোথাও না কোথাও দুর্নীতির খবর।
আলিপুরদুয়ার পুর এলাকায় আবাসের টাকায় ভূতের ভোজ, জয়গাঁর উন্নয়নের বরাদ্দ হাপিস, মালবাজারে পুরসভার চেয়ারম্যানের উদ্যোগে কোটি কোটি সরকারি টাকার মহোৎসব।
ক্রমশ দক্ষিণে চলুন। শিলিগুড়িতে অবাধে জমি দখল, বাধা দিলে হামলা, এমনকি খুন। চা বাগানের জমি দখল করে বেআইনি বাজার। তৃণমূল নেতা অলক চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে চা বাগানের জমি দখল করে রিসর্ট নির্মাণের চেষ্টার অভিযোগ। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের কোটি কোটি টাকার তছরুপের প্রমাণ ক্যাগ রিপোর্টে। জাল নোট পাচার, আগ্নেয়াস্ত্রর কারবার, মাদকের ব্যবসায় মালদা সারাবছরই সংবাদ শিরোনামে।
চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতানো, নদী থেকে অনুমতিহীন বালি-পাথর খনন, নদী বা সরকারি জমি দখল করে বেআইনি নির্মাণ ইত্যাদি এখন জলভাত উত্তরবঙ্গে। ট্যাব দুর্নীতির ছোঁয়া দিনহাটাতেও। টাকা আর টাকা… শুধু কাঞ্চনের লোভে ছুটছে উত্তরবঙ্গ। যার একটি কানাকড়িও বৈধ রোজগার নয়। নৈতিক পথে উপার্জন হবেই বা কোথা থেকে! চাকরির সংস্থান কোথাও নেই। চা ছাড়া শিল্প বলে কিছু নেই। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ। পর্যটন সম্ভাবনা থাকলেও পরিকাঠামো নেই।
মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে দু-একটা চাকরি বাগালে লক্ষ্য থাকে, কীভাবে কত দ্রুত উপরি কামিয়ে ঘুষের টাকাটা তুলে নেওয়া যায়। শিক্ষকরাও সে কারণে দুর্নীতিতে জড়ান। ট্যাব কেলেঙ্কারিতে ধৃতদের অন্তত ২ জন শিক্ষক। মিড-ডে মিলের চাল চুরিতে শিক্ষকরা জড়িত শুনলে মনটা ছ্যাছ্যা করে ওঠে। শিক্ষক দম্পতির সন্তান তো! শিক্ষকদের দুর্নীতি তাই পাঁজর ভেঙে দেয়।
ভাবতে বসি, সারল্য, স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেল কেন? সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তের ব্রেন চাইল্ড পঞ্চায়েত ব্যবস্থা মানুষকে স্বশাসন দিয়েছিল। দুর্নীতির ভিসুভিয়াসের মুখও খুলে দিয়েছিল। বরাতপ্রাপ্ত কাজের ৫ শতাংশ কমিশন পঞ্চায়েত প্রধানদের দেওয়াটা ঠিকাদাররা নিয়ম করে ফেললেন। কোনও সৎ প্রধান নিতে না চাইলে তাঁর বৌকে দিয়ে আসা হত, বৌদি এটা রাখুন বলে।
ক্রমে ক্রমে লোভ বাড়ল। কমিশনের পরিমাণ বাড়ল। শুধু প্রধান নয়, অন্য সদস্য থেকে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, পুরসভায় ছড়িয়ে পড়ল কমিশনের বিষ। বৈধ পথে চাকরি দুর্লভ হয়ে গেল। মোটা নজরানা না দিলে ব্যবসা করাও দায়। রাজনৈতিক বলয়ের অংশ হয়ে গেলেন ঠিকাদাররা। কালক্রমে শুধু টাকা জোগানোর গৌরী সেন রইলেন না ঠিকাদাররা, হয়ে উঠলেন দলের নিয়ন্ত্রক। সাধে কী সিপিএম নেতা বিনয় চৌধুরী সরকারটাকে ‘অফ দি কনট্রাক্টর্স, বাই দি কনট্রাক্টর্স’ বলেছিলেন।
তৃণমূল জমানায় অবশ্য ঠিকাদাররাই হয়ে গেলেন নেতা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার হুঁশিয়ারি দিলেন, ঠিকাদারি আর তৃণমূল একসঙ্গে- কভি নেহি কভি নেহি। বলাই সার, অচলায়তনে সামান্য ধাক্কাও লাগল না। ঠিকাদাররাজ জিন্দাবাদ জমানা চলছে। ঠিকাদার, প্রোমোটাররা কিন্তু সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়ে। তাঁদের দোষ কী? চাকরি নেই। ব্যবসা করার পুঁজিও নেই। ধান্দাবাজি আর নেতাদের তেল (পড়ুন কাটমানি) দিয়ে ট্যাঁকে মোটা টাকা ঢোকা তো বাঘের রক্তের স্বাদ পাওয়ার মতো।
সেই স্বাদের টানে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের জীবনেও এখন ধান্দা জিন্দাবাদ। সাদা না কালো দেখার দরকার নেই, টাকা তো। জীবন ভরে উঠছে বিলাসব্যসনে, যথেচ্ছাচারে। নীতি নিয়ে যেহেতু মাথাব্যথা নেই এবং উপযুক্ত কাজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তাই এই কালাধান্দায় প্রশ্রয় জুগিয়ে যান সব শাসকদলের নেতারা। দলের তহবিল যত না স্ফীত হয়, তার কয়েক গুণ ঢোকে নেতাদের ট্যাঁকে।
অন্যের টাকা, জমি হাপিস করে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কারবার তাই জেনেও চোখ বন্ধ তৃণমূল নেতাদের। চোপড়ায় ট্যাব কেলেঙ্কারি অজানা ছিল না সেখানকার নেতাদের। তাঁরা চোখ বন্ধ রাখলে পদক্ষেপ করার সাহস পুলিশ বা প্রশাসনেরও থাকে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উত্তরের জনপদ তাই সারল্য হারিয়ে ধান্দার নরকে পরিণত হয়েছে।