প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: রবিবার নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার আগেই সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়াল দেশের ২০টি বিরোধী রাজনৈতিক দল। তবে শুধু সংসদ বয়কটই নয়, আসন্ন সংসদীয় বাদল অধিবেশনে কেন্দ্রবিরোধী অবস্থান মজবুত রেখে অন্যান্য বৃহত্তর ইস্যুভিত্তিক দাবিদাওয়া ঘিরেও একজোটে আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বিরোধীরা। নতুন পার্লামেন্টে পা রাখা মাত্র যে প্রবল বিধ্বংসী ঝড়ের ইঙ্গিত দেখা দিয়েছে তা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে পারে মোদি সরকার, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
২৮ মে, রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে উদ্বোধন হবে ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন সংসদ ভবন। বিরোধীদেরও জানানো হয় আমন্ত্রণ। এরপর প্রকাশ্যে আসে ওইদিন আসলে আরএসএস তথা হিন্দু মহাসভার অবিংসবাদী নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ১৪০তম জন্মবার্ষিকী ও কার্যত নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের সূত্রে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে চায় কেন্দ্রীয় শাসক দল। এই খবরে বারুদে আগুন লাগে। দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের এক মাত্র অভিভাবকস্বরূপে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে কোনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মুহূর্তে পরিস্থিতি রীতিমতো অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় সরকারী নীতির তীব্র সমালোচনা করে প্রথমে কংগ্রেস, পরে তৃণমূল কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টিও উদ্বোধন বয়কট করে। মঙ্গলবারই তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন টুইট করে সংসদ ভবনের উদ্বোধন বয়কট করার ডাক দেন।
আজ, বুধবার মোট ২০টি বিরোধী দলের তরফে যৌথ বিবৃতি জারি করে জানানো হয়, সবকটি দলই নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করবেন। নতুন সংসদ ভবনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এর প্রতিবাদেই তারা সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না। যখন সংসদ থেকে গণতন্ত্রের আত্মাকে শুষে নেওয়া হয়েছে, তখন এই নতুন বিল্ডিংয়ের কোনও দাম নেই আমাদের কাছে।’ বিরোধীদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতিকে নয়া সংসদভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাঁদের দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদির বদলে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সংসদ ভবন উদ্বোধন করা উচিত। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের তরফে আগামী রবিবারের নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধন কর্মসূচি বয়কটের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হল বিরোধীদের কাছে। কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী বুধবার বলেন, ‘কিছু বিরোধী দল নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন বয়কটের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। আশা করব, তারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে এবং কর্মসূচিতে যোগ দেবে।’ এই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘এই সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সকলের উপস্থিত থাকা উচিত। ভারত সরকার সবাইকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই এর উদ্বোধন এবার সবাই নিজের ভাবনা অনুযায়ী কাজ করবেন।’
মঙ্গলবারই তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন টুইট করে জানান, তৃণমূল কংগ্রেস নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করছে। সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে তিনি টুইটে লেখেন, ‘সংসদ শুধু একটা নতুন বিল্ডিং নয়, এটা ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, নিয়মের প্রতিষ্ঠান। এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্থর। প্রধানমন্ত্রী মোদি এটা বোঝেন না। তাঁর কাছে রবিবারে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন পুরোটাই শুধু নিজেকে নিয়ে। তাই আমাদের আমন্ত্রিতের তালিকা থেকে বাদ রাখুন।’ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টির তরফেও রবিবারের সংসদ ভবনের উদ্বোধন বয়কট করার কথা জানানো হয়। আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং জানান, রাষ্ট্রপতিকে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানোর প্রতিবাদে তারা অনুষ্ঠান বয়কট করছেন। সিপিআই সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা জানান, দলের কোনও সদস্য এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না। সিপিএমের তরফে বয়কটের কথা না বলা হলেও, রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘যখন সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়েছিল, তখনও মোদি রাষ্ট্রপতিকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তাই করা হল। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
উল্লেখ্য, নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রায় ২০টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি চরম অস্বস্তি ও বেকায়দায় ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। বাদল অধিবেশনের প্রাক মুহূর্তে সংসদ ভবন উদ্বোধন বয়কট করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বৃহত্তর জনস্বার্থে সংসদীয় পরিসরে এককাট্টা হবে বিরোধীরা, আজ তেমন আভাস দিয়েছেন বিরোধী দলনেতারা। এরমধ্যে অন্যতম আসন্ন বাদল অধিবেশনে দিল্লির ‘আপ’ সরকারকে উৎখাত করতে কেন্দ্রের নিয়ে আসা অধ্যাদেশকে সংসদের উচ্চকক্ষে রুখে দেওয়াই বিরোধীদের সাম্প্রতিকতম এজেন্ডা।
এপ্রসঙ্গে, ইতিমধ্যেই সমর্থনের আশায় কলকাতায় সফরে এসে তৃণমূলনেত্রী ও বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন টিম কেজরিওয়াল। মমতার পরিকল্পনা মেনেই রাজ্যসভা সংখ্যাতত্ত্বের জেরে গেরুয়া শিবিরের জয়রথ থামানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে বিরোধীরা। পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, ২০০০ টাকার নোট প্রত্যাহার, আদানি প্রতারণা ইস্যুর মতোন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একজোট হয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মোর্চা বের করার পরিকল্পনা নিতে চলেছে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শিবির। ২০২৪’র রণকৌশল পদক্ষেপের সলতে পাকানোর কাজ এখন থেকে সময় থাকতেই শুরু করে দিতে চান বিরোধীরা। এদিকে শুধু সংসদ ভবন উদ্বোধন নয়, ২৭ মে নীতি আয়োগের শীর্ষ বৈঠকেও আসছেন না বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এবার তাঁকে অনুসরণ করে বৈঠকে মিলিত হয় কিনা অন্যান্য বিরোধী দলগুলি, এখন তাই দেখার।