রুদ্র সান্যাল
একসময় প্রেমপত্র ছিল হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশের মাধ্যম। আজ তা ইনবক্সের সংক্ষিপ্ত বার্তা। সম্পর্ক শুরু হয় ফেসবুক রিকোয়েস্টে, গভীর হয় মেসেঞ্জারে, আর শেষ হয় ব্লক লিস্টে।
কদমফুলের ভালোবাসা এখন গিফট কার্ডে সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তি জীবন সহজ করেছে, কিন্তু এই সহজের আড়ালে কিছু কি হারিয়ে যাচ্ছে? এই দ্রুতগতির ভার্চুয়াল জীবন কি কেড়ে নিচ্ছে আমাদের আবেগ ও সম্পর্কের গভীরতা?
আগের প্রেমিক কবিতার মতো লিখত, ‘তোমার চোখ যেন রাতের তারা…’ এখনকার প্রেমিক লেখে, ‘তোমায় মিস করছি, ফোন করো!’ প্রশ্ন ওঠে, রোমান্স কি কমল, নাকি ইন্টারনেটের গতির মতো দ্রুত হয়ে গেল?
প্রযুক্তির প্রভাব শুধু প্রেমে নয়, সম্পর্কেও গভীর ছাপ ফেলেছে। অতিথি এলে চা অর্ডার হয় অনলাইনে, মুখোমুখি আড্ডা হারিয়েছে স্মার্টফোনে, আর চায়ের টেবিলেও চলে সাইলেন্ট স্ক্রলিং। চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় যে আনন্দ, উদ্বেগ আর আশা ছিল, হোয়াটসঅ্যাপে ‘সিন’ দেখে উত্তর না এলে এখন অস্থিরতা বাড়ে। ধৈর্যের জায়গায় এসেছে একধরনের আত্মঘাতী তাড়াহুড়ো।
তবে প্রযুক্তির সুবিধাও অনস্বীকার্য। গুগল ম্যাপে পথ জানা যায়, মায়ের মেসেজ আসে ফোনে, লাইব্রেরির বদলে গুগলে মেলে তথ্য। দ্রুত তথ্যপ্রাপ্তি এবং যোগাযোগ নিঃসন্দেহে জীবনের গতি বাড়িয়েছে। ঘরে বসেই দুনিয়ার খবর রাখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল অকল্পনীয়। দূরত্ব কমেছে, হাতের মুঠোয় এসেছে বিশ্ব, যা আমাদের জীবনকে আরও সহজ ও গতিময় করেছে।
কিন্তু এত আরামেও কি কিছু হারাচ্ছি না আমরা? সেই সম্পর্কের উষ্ণতা, চোখের দিকে তাকিয়ে কথোপকথনের সরল আনন্দ কি নেই হয়ে যাচ্ছে? আমাদের নস্টালজিয়ার জায়গা দখল করছে নোটিফিকেশনের ভিড়। উৎসবে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখার বদলে প্রত্যেকে ডুবে থাকে নিজের স্ক্রিনে, এমনকি পরিবারের মধ্যেও বাড়ছে ভার্চুয়াল দূরত্ব। এই স্ক্রিন-নির্ভরতা ক্রমশ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে বাস্তব সম্পর্কগুলো থেকে। মানবিক আবেগ, পারস্পরিক বোঝাপড়া ফিকে হয়ে আসছে, যার প্রভাব আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যেও।
আরেকটি আশঙ্কাজনক দিক হল সৃজনশীলতার হ্রাস। ছোটবেলায় গল্প লেখা বা হাতের লেখা সুন্দর করার যে অনুশীলন ছিল, যার মধ্য দিয়ে ভাষার সৌন্দর্য ও ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ত, তা এখন হারিয়ে যাচ্ছে টাইপিং আর রেডিমেড মেসেজের সহজলভ্যতায়। শব্দের গভীরতা বা আবেগের নিজস্ব প্রকাশ ক্রমশ অনুপস্থিত হচ্ছে, যা ভাষার সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে।
প্রযুক্তির প্রেম নিঃসন্দেহে মধুর, কিন্তু তার পরিণতি অনেক সময় মিশ্র। আমাদের উচিত প্রযুক্তিকে নিজের মতো ব্যবহার করা, তার দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া নয়। ইন্টারনেট থাকুক, তবে আন্তরিক যোগাযোগও যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি মানবিক বোধও যেন টিকে থাকে।
তাই আজই প্রিয় বন্ধুকে একটা ফোন করুন, পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করুন। অন্তত একদিনের জন্য হলেও স্ক্রিনের বাইরে এসে জীবনের বাস্তব রং অনুভব করুন। আর সেই মুহূর্তের ছবি ইনস্টাগ্রামে না দিলেও কিছু এসে যাবে না-কারণ ভালোবাসা, যোগাযোগ আর অনুভূতি-এসব জিনিস পোস্টের জন্য নয়, বেঁচে থাকার জন্য! প্রকৃত সুখ ও তৃপ্তি আসলে ডিজিটাল জগতে নয়, বরং বাস্তব সম্পর্কের বুননে নিহিত।
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক)