রূপায়ণ ভট্টাচার্য
আল জাজিরা চ্যানেলে বছর দুই আগে পাকিস্তানের দুই প্রতিভাবান জিমনাস্টকে নিয়ে তথ্যচিত্র দেখিয়েছিল। পাকিস্তানে দুজনে অপ্রতিরোধ্য। অথচ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার কোনও অধিকার নেই করাচির ছেলেমেয়ে দুটির। কারণ? তাঁরা বাঙালি।
স্বপ্ন দেখেন দুজনে। এবং সেই স্বপ্ন মরে যেতে থাকে করাচির এক সুবিশাল বস্তির আবর্জনায়, পূতিগন্ধময় ড্রেনে।
বিমানে মুম্বইয়ে যাচ্ছেন হয়তো। ল্যান্ড করার সময় নীচে তাকালে অবশ্যই দেখেছেন ধারাভি বস্তি। মানুষ কত কষ্টে থাকে, তার ইঙ্গিত দিয়ে যায় ওই ভয়ংকর দৃশ্যমালা। একইরকম হিমশীতল অনুভূতি হয় ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো বিমানবন্দরে নামার সময়। নীচে চোখে পড়বে ফাভেলা– সেখানকার কুখ্যাত বস্তি। খুন, ছিনতাই, ড্রাগস পাচারই সেখানে জীবনের অন্য নাম।
করাচির ওই মচ্ছর বস্তি এমনই ভয়ংকর। দিনে-দুপুরে আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে। ৭ লক্ষ লোক সেখানে। অন্তত ৬৩ শতাংশ স্পষ্ট বাংলায় কথা বলেন। এমন আরও তিনটি বস্তি পাবেন করাচিতে। এসআইটিই টাউনে চিটাগং কলোনি। অন্যদিকে মুসা কলোনি। সর্বত্র এখনও বাংলায় কথা বলে লোক। কতদিন পারবে জানি না।
এখানকার অন্য নাম ভয়াবহ দারিদ্র্য। ঘুপচি বাড়ি, উপচে পড়া নর্দমা চারদিকে, রাস্তা হয়নি অনেক জায়গায়। করাচিতে লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না করে, পরিচারকের কাজ করে তাঁদের রোজগার। অথচ এত বছরেও এঁদের নাগরিকত্ব দেয়নি পাক সরকার। আগে দেওয়া পরিচয়পত্র তুলে নেওয়া হয়েছে অনেক বছর। মাঝে মাঝেই পুলিশ এসে বলে, পরিচয়পত্র দেখাও। না দেখাতে পারলেই ঘুষ দিতে হয়। তাঁরা কার্ড না থাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না, পারেন না ভালো স্কুলে ছেলেদের পাঠাতে। সরকারি চাকরি জোটে না, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুবিধেও। হাজার ঝামেলা, হাজার কৈফিয়ত।
তাঁরা তাহলে কোন দেশের নাগরিক, এতদিনেও মীমাংসা হয়নি। সরকারি কার্ড না পাওয়ায় ক্লাস এইটের পর পড়াশোনা বন্ধ। ভর্তিই নেবে না স্কুল। ভবিষ্যৎ? শুধু লোকের বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করা। মচ্ছর কলোনির কিছু মহিলা রাত তিনটে থেকে চিংড়ি মাছের খোসা ছাড়ান প্রচুর কষ্ট করে। ১০ কেজি চিংড়ির খোসা ছাড়ালে মেলে ১৫০ টাকা। বরফে রাখা মাছ নিয়ে কাজ করলে হাতের চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। কিছু করার নেই, স্বামী বেকার। মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যায় আরব সাগরে।
তিনটি বস্তিকেই করাচির লোকে বলে ‘মিনি বাংলাদেশ’। আর একটা জায়গা আছে ওরাঙ্গি টাউন। সেখানে বাংলাদেশের বিহারি মুসলমানরা ১৯৭১ সালের পর এসে ডেরা বাঁধেন।
দুটো কারণে এই অসহায় পাকিস্তানি বাংলাদেশিদের কথা মনে পড়ল এই সময়।
এক, বিদ্বেষের বাংলাদেশে পাকিস্তান প্রীতি রাতারাতি অবিশ্বাস্য বেড়ে গিয়েছে। পাকিস্তানই যেন স্বর্গ। মুজিবুরের মুক্তিযুদ্ধকে অকথ্য গালাগাল দিয়ে ওই সময়ের রাজাকারদের বন্দনা চলছে দেশে। অনেকেরই ধারণা, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হলে নাকি সব সমস্যার সমাধান অনিবার্য।
দুই, নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের সাম্প্রতিকতম পোস্ট। সেখানে তিনি এই বাংলাদেশি পাকিস্তানিদের দুর্দশা নিয়ে সোচ্চার।
তসলিমা শুরুই করেছেন এভাবে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে বাঙালিরা পাকিস্তানের প্রেমে দিশেহারা, তাঁরা তো ইচ্ছে করলেই পারেন পাকিস্তানে চলে যেতে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার চেষ্টা না করে খোদ পাকিস্তানেই তো বাস করা উত্তম।’ তাঁর যুক্তি অকাট্য, ‘যে বাঙালিরা ইউরোপকে ভালেবাসে, তারা ইউরোপে গিয়ে বাস করছে। যারা আমেরিকাকে ভালেবাসে, তারা আমেরিকায় গিয়ে বাস করছে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে বাস করতে চায়, তারা সেখানে বাস করছে। পাকিস্তানে ৩০ লক্ষ বাঙালি বাস করেন, সুতরাং সেটল করতে কোনও অসুবিধেই হবে না। বাঙালিরা যে-সব বস্তিতে বাস করেন, তাঁরাও বাস করতে পারেন সেসব নোংরা বস্তিতে।’
তসলিমার পরবর্তী বিদ্রুপ, ‘পাকিস্তান তাঁদের কোনও পাসপোর্ট দেবে না, কোনও জাতীয় পরিচয়পত্র দেবে না, তাতে কী! এমন পবিত্র ইসলামিক রাষ্ট্রে বাস করলে পুণ্য অর্জন তো হবে। পুণ্যের বোঝা ভারী হলে শর্টকাটে বেহেস্তও তো তাঁরা পেয়ে যাবেন। তবে আর দেরি কেন?’
বছর দেড়েক আগে পাকিস্তানের নামী কাগজ ট্রিবিউন এক রিপোর্ট করেছিল করাচির বাংলাভাষী মহিলাদের যন্ত্রণা নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছিল, তিরিশ লক্ষ বাঙালি বাস করেন পাকিস্তানে। মচ্ছর কলোনিতেই সংখ্যাটা ৮ লক্ষ। সালমা, নুরিন নূর মহম্মদ, নাজমা বিবিরা সেখানে উজাড় করে বলেছিলেন যন্ত্রণার কথা। কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়। সাংবাদিক আলিয়া বুখারি কথা বলেছিলেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মুনিস আহমারের সঙ্গে। তিনি খোলাখুলি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর অধিকাংশ বাঙালি পাকিস্তান ছেড়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলেন। যাঁরা থেকে গিয়েছেন, তাঁদের বারবার দুটো জিনিসের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। দারিদ্র্য এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রমাণের যুদ্ধ।’
পাক অধ্যাপক ছিলেন ফ্যাকাল্টি অফ সোশ্যাল সায়েন্সের প্রাক্তন ডিনও। তাঁর বিশ্লেষণে উঠে আসে নতুন তথ্য, ‘সত্তর দশকের শেষদিকে আর আশির দশকে ১০ লক্ষ বাংলাদেশি পাকিস্তানে ফিরে এসেছিলেন এখানে থাকবেন বলে। এখানে ভবিষ্যৎ ভালো হবে বলে। ভালো চাকরি মিলবে বলে। পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা খারাপ দেখে অধিকাংশই হতাশ হয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান। যাঁরা থেকে গিয়েছেন, তাঁরা মারাত্মক অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন।’
আল জাজিরার ২০২১ সালের এক রিপোর্টের শিরোনাম ছিল– স্টেটলেস ও হোপলেসঃ দ্য প্লাইট অফ এথনিক বেঙ্গলিজ অফ পাকিস্তান। কোনও গোদি মিডিয়া নয়, হিন্দুত্ববাদী কাগজ নয়। কাতারের আল জাজিরা মুসলিম দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য মিডিয়া। সেখানে হাজিরা মরিয়ম কথা বলেছিলেন পাকিস্তান বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুহাম্মদ সিরাজের সঙ্গে। তাঁর অভিযোগ চাঞ্চল্যকর, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের ভিনদেশি, শরণার্থী বলে দাগিয়ে দেয়। আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। আমরা বাঙালি, কিন্তু পাকিস্তানি বাঙালি। আমাদের অধিকাংশেরই আইডি কার্ড দেওয়া হয়নি। যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে থেকে ওরা আছে পাকিস্তানে।’
এই আইডি কার্ড নিয়ে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা রয়েছে, যার কেন্দ্রে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দুই প্রাক্তন নারী রাষ্ট্রনায়ক। বেনজির ভুট্টো ও খালেদা জিয়া। বেনজির এই পাকিস্তানি বাঙালিদের বাংলাদেশে তাড়াতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। একবার দুটো বিমানভর্তি পাকিস্তানি বাঙালিদের পাঠিয়েও দেন বাংলাদেশে। ঢাকায় পৌঁছোনোর পর খালেদা জিয়ার সরকার তাঁদের আটকে দেয়। বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানি বাঙালিদের।
বেনজির ও ইমরান খানের যত রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকুক, এখানে তাঁরা একই পথের পথিক। ভোটে জেতার আগে ইমরান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি বাঙালিদের নাগরিকত্ব দিতে হবে।’ ভোটে জিতেই সব ভুলে গিয়েছেন। বাংলাদেশিদের মতোই দুর্দশা পাকিস্তানে বার্মিজ ও ইরানিয়ানদের।
পাকিস্তানে থেকে যাওয়া বাংলাদেশিদের একটা ম্যানুয়াল কার্ড দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। প্রথমদিকে মোটামুটি চলে যেত ওই কার্ডে। সমস্যা শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। পাকিস্তান যখন থেকে ন্যাশনাল ডেটাবেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি (নাদরা) তৈরি করল। শুরু হল আইডি কার্ডের ডিজিটাইজেশন। এবং পাকিস্তানি বাঙালিদের সর্বনাশের শুরু। তাঁদের বলা হল, নাগরিক পরিচয় দেওয়ার মতো উপযুক্ত প্রমাণপত্র নেই।
পাকিস্তানি বাঙালিদের এত দারিদ্র্য ও অস্তিত্বের সংকটে দিন কাটলেও এঁদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে বিশিষ্ট নাম। ঢাকার শেষ নবাব খোয়াজা হাসান আসকরি জন্মেছিলেন ঢাকায়। শুয়ে আছেন করাচির সেনা কবরখানায়। মুহাম্মদ মাহমুদ আলম জন্মেছিলেন কলকাতায়। পঁয়ষট্টির যুদ্ধে এক মিনিটে ভারতের পাঁচটা যুদ্ধবিমান শেষ করার বিশ্বরেকর্ড তাঁর। তিনিও শেষশয্যা নিয়েছেন করাচিতে।
নামী পপ গায়ক, হাওয়া হাওয়া গানের স্রষ্টা হাসান জাহাঙ্গির গানের জগতে দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন করেন বাংলা গান ‘দোল দোল দোলুনি’ দিয়ে। পাকিস্তানের সুপারস্টার জুটি রহমান ও শবনম বাংলার মতো উর্দু ছবি করেছেন অনেক। শবনমের আসল নাম ঝর্ণা বসাক, তাঁর স্বামী সুরকার রবিন ঘোষ। মেহদি হাসান তাঁর মৃত্যুশয্যায় শবনমের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। ২৮ বছর পাকিস্তানের এক নম্বর অভিনেত্রী থাকা সেই শবনম আজ ঢাকায়, কাগজে তাঁর খবরও বেরোয় না।
সিলেট-কন্যা রুনা লায়লা ১৯৭৪ পর্যন্ত পাক নাগরিক ছিলেন। পাকিস্তানি ফিল্মে প্রচুর গান। তাঁর মা গায়িকা অনিতা সেন হিন্দু, মামা বাঙালির প্রিয় গায়ক সুবীর সেন। শাহনওয়াজ রহমুতুল্লা পাকিস্তানের সবচেয়ে পরিচিত দুটি দেশপ্রেমের গান গেয়েছিলেন। জিয়ে জিয়ে পাকিস্তান এবং সোহনি ধরতি। পরে চলে যান জন্মভূমি ঢাকায়। গজলে পাকিস্তান মাতানো মুন্নি বেগম তো মুর্শিদাবাদের মেয়ে।
রাজনীতিতে আসুন। বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ফজলুল হক পাকিস্তানি বাঙালির দলে পড়বেন। পাকিস্তানের দুই প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আলি বোগরা (জন্ম বগুড়া) খোয়াজা নাজিমুদ্দিন (জন্ম ঢাকা)-ও। সেই অর্থে জিন্না-ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও পাকিস্তানি বাঙালি। যদিও মোহভঙ্গ হলে দুজনেই ফিরে আসেন এই বাংলায়।
এই যে এত এত স্মরণীয় নাম পাকিস্তানি বাঙালিদের মধ্যে। তারপরেও কেন আজকের পাকিস্তানে বাঙালিদের চরম হেনস্তা? পদ্মাপারে পাক প্রেমিক বাঙালিরা এই কথাগুলো ভাবলে বাংলাদেশেরই মঙ্গল।