শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি: সপ্তমীর সন্ধ্যায় বৃদ্ধা মাকে স্কুটারে চাপিয়ে উমা-দর্শনে বেরিয়েছিলেন অসিতবরণ দে। ফুলেশ্বরীর রেলগেটের মুখে এসে থমকে গেলেন তিনি। সামনে তখন প্রবল যানজট। গাড়ি-বাইকের হর্নের আওয়াজে কান পাতাই দায় সেখানে। টোটো, রিকশা, চারচাকার গাড়ি, বাইক, অটো সব একজায়গায় যেন দলা পাকিয়ে গিয়েছে। ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় সেখানে আটকে ঘেমে-নেয়ে একাকার অসিত। বৃদ্ধা মা-ও আর বসে থাকতে পারছেন না। ছটফট করছেন অনবরত। ‘ঠাকুর দেখতে বেরোনোটাই ভুল হল’, বলছিলেন বছর পঁচাত্তরের মহিলা। অসিতের গলাতেও একরাশ ক্ষোভ ও হতাশা। হবে নাই বা কেন, প্রায় ঘণ্টাখানেক ওই যানজটে ফেঁসে থাকলেও নিদেনপক্ষে একখানা পুলিশকর্মীর দেখা মেলেনি সেখানে। পথচলতিরাই কোনওমতে যানজট কাটানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ক’জন শোনে তাঁদের কথা! অগত্যা চূড়ান্ত ভোগান্তি পোহাতে হল সকলকে।
ওইদিনই ভেনাস মোড়ের ফ্লাইওভার পেরিয়ে এনটিএস মোড় হয়ে দাদাভাই ক্লাবের মণ্ডপ দেখতে যাচ্ছিলেন বিকাশ সরকার। বাইকে স্ত্রী ও সন্তানকে বসিয়ে যখন তিনি টিকিয়াপাড়া মোড়ে পৌঁছালেন, তখন এনটিএস মোড়ে যাওয়ার রাস্তায় গাড়ির বিরাট লাইন। ওই লাইন পেরিয়ে দাদাভাই স্পোর্টিং ক্লাবের সামনে পৌঁছাতেই তাঁর লেগে গেল দেড় ঘণ্টারও বেশি সময়। হতাশার সুরে বিকাশকে বলতে শোনা গেল, ‘এত কড়াকড়ি করে লাভ কী হল? সেই তো প্রবল যানজটের মধ্যেই পড়তে হল।’
পুজোয় শহরের যান নিয়ন্ত্রণে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছিল পুলিশ। তাতে মূল রাস্তাগুলোয় খানিক লাভ হয়েছে বটে, কিন্তু অলিগলিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে দর্শনার্থীদের। হাকিমপাড়ার দেবাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেই ফেললেন, ‘এবার যাননিয়ন্ত্রণে পুলিশের শূন্য পাওয়া উচিত। এত অব্যবস্থা কোনও বছর দেখিনি।’ শুধু পুজোর ক’দিন কেন, সোমবার কার্নিভালের জন্যও দিনভর হ্যাপা পোহাতে হয়েছে শহরবাসীকে। সন্ধ্যায় কার্নিভাল হলেও দুপুর থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল একাধিক রাস্তা। পুজোর এই কয়েকদিন যানজট এতটাই ছিল যে খোদ ডিসিপি (ট্রাফিক) বিশ্বচাঁদ ঠাকুরকে শহরে চরকিপাক খেতে হয়েছে। কখনও তিনি ছুটে গিয়েছেন ভেনাস মোড়ে, কখনও আবার দাদাভাই মোড়ে। বিশ্বচাঁদ অবশ্য দাবি করছেন, ‘শহরবাসী এবারে গাড়ি, বাইক নিয়ে ঘুরতে পেরেছে। একটু চাপ হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের। তবে, প্রত্যেকেই অত্যন্ত খেটেছে।’
পুলিশ যাই বলুক না কেন, বাস্তব বলছে অন্য কথা। এই যেমন দশমীর রাতের কথাই ধরা যাক। ফুলেশ্বরী থেকে যে রাস্তাটি অশোক ভটাচার্যের বাড়ি হয়ে সুভাষপল্লির দিকে গিয়েছে, সেই এঁদো গলিতে ভরসন্ধ্যায় ঢুকে পড়েছিল বিশাল একখানা বাস। অগত্যা অনিবার্য যানজটে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। স্থানীয় একজন যা দেখে পুলিশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে লাগলেন, ‘এই তো হচ্ছে অবস্থা। এত কড়াকড়ি থাকলে গলির ভেতর বাস ঢুকল কীভাবে?’ আশ্চর্যের ব্যাপার সেখানেও দেখা মেলেনি কোনও পুলিশকর্মীর। একই ছবি দেখা গিয়েছে পুজোর চারদিন শহরের অন্যত্র। বিশেষ করে দাদাভাই, সুব্রত সংঘের কাছে, গেটবাজার থেকে সেন্ট্রাল কলোনি যাওয়ার রাস্তায়, পাকুরতলা মোড়, সুভাষপল্লিতে যানজটে নাকানি-চোবানি খেতে হয়েছে সকলকে।
শুক্রবার আনন্দময়ী কালীবাড়িতে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়াকে কেন্দ্র করে আশপাশের রাস্তা পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই যানজট পেরিয়েই পুজো দিতে আসছিলেন মনীষা দাস। তিনি বলছিলেন, ‘গাড়ি-বাইকের লাইন পেরিয়ে কীভাবে যে পুজো দিতে এলাম, বলে বোঝানোর নয়।’ শুধু প্রধান রাস্তাগুলোতেই নয়, সংলগ্ন রাস্তাগুলিরও ছিল যানজটে ভরা। সপ্তমীর দিন এই যানজটের মধ্যে পড়ে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছিলেন চন্দন কর্মকার। তাঁর কথায়, ‘কোথায় সিভিক ভলান্টিয়াররা। ট্রাফিকে চালান কাটার সময় ওদের দাদাগিরি দেখা যায়। এখন যানজট সরাতে কারও টিকিটি পাওয়া যাচ্ছে না।’
মহানন্দা পাড়া হয়ে হিলকার্ট রোডে ওঠার মুখে ডাইভারশনের জন্য টোটো ঘোরাতে গিয়ে বারবার যানজট হচ্ছিল। শহরের বাসিন্দা প্রদীপ দাস বলছিলেন, ‘ডাইভারশনটাও কোথাও যেন আরও বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল আমাদের কাছে।’ সবমিলিয়ে, ট্রাফিকের তরফে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও যানজটে অবরুদ্ধ পথ পেরিয়েই প্যান্ডেল হপিং করতে হল শহরবাসীকে।