আলিপুরদুয়ার: মনে করুন, আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়ার দিকে যাচ্ছেন। ১২ কিলোমিটার পথ পেরোতে না পেরোতেই আপনার সামনে পড়বে বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের অধীনে থাকা পানিঝোরা গ্রাম। বক্সাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একাধিক জনপদের মধ্যে এই গ্রামটা একটু অন্যরকম হয়ে উঠতে চলেছে আর মাস কয়েকের মধ্যেই। কেননা, এই গ্রামটাকেই আপনকথা নামে একটি সংগঠন এবং আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন বেছে নিয়েছে বইগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। এর আগে মহারাষ্ট্র ও কেরলে এমন উদ্যোগ চোখে পড়েছিল। তবে এ রাজ্যে সম্ভবত পানিঝোরাই প্রথম বইগ্রাম।
গ্রামে ঢোকার মুখেই আপনার চোখে পড়বে একটি তোরণ। বইকে থিম হিসেবে রেখে কাঠের তৈরি গাছের আদলে হবে সেই তোরণ। সেখানে থাকবে বইয়ের রেপ্লিকা ও ছোট লাইব্রেরির রেপ্লিকা। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি ছোট লাইব্রেরি বানাবার কাজও চলছে।
কাঠের তৈরি সেই তোরণ পেরিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেই চোখে পড়বে বইগ্রামের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বানানো একটা ফলক। গ্রামের ভেতরে ১০টা বাড়ির সামনে বানানো হবে ‘আলোকবর্তিকা’। আলোকবর্তিকা হল কাঠের তৈরি ছোট লাইব্রেরি। সেগুলোর প্রত্যেকটিতে গল্পের বই, বিজ্ঞানের বই, সামাজিক সচেতনতামূলক বই সহ নানা স্বাদের বই থাকবে। ওই গ্রামের ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক ছোট লাইব্রেরিগুলোর দেখভাল করবেন। আগ্রহী পাঠকরা বই নিয়ে, পড়ে আবার ফেরত দিয়ে যাবেন।
এছাড়া গ্রামে থাকবে একটি বড় আকারের লাইব্রেরি। আপাতত তা বানানো হবে ওই গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলের একটি ঘরে। যেখানে দুটি আলমারিতে ৫০০-রও বেশি বই থাকবে। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে থাকবে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় বইও। যার দেখভাল করবেন ওই গ্রামের ২ জন স্বেচ্ছাসেবক। পরবর্তীতে জমি পেলে ওই গ্রামেই পাকাপাকিভাবে বড় গ্রন্থাগার তৈরি হবে। সেখানে মাসে একদিন কম্পিউটার শেখানোর সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চাও করানো হবে। পাশাপাশি গ্রামের ৫০টি বাড়ির দেওয়াল শিক্ষামূলক, বইকেন্দ্রিক, মনীষীদের বাণী দিয়ে সাজানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। আলিপুরদুয়ারের জেলা শাসক আর বিমলার কথায়, ‘এটা একটা পাইলট প্রোজেক্ট। বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে। শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস করাতে হবে। সেটাই লক্ষ্য।’
বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের অধীন এই গ্রামে ৭টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী সহ তপশিলি-অনগ্রসর শ্রেণির বাসিন্দাদের বসতি। এই গ্রামে প্রায় ৩২০ জন বাসিন্দা রয়েছেন। তাতে আবার প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াই বেশি। তবে সেই পরিস্থিতি বেশিদিন থাকবে না। এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বঙ্গরত্ন প্রমোদ নাথ বললেন, ‘এই গ্রামের ওপর সমীক্ষা করা হচ্ছে। যারা নিরক্ষর তাদের স্বাক্ষর করবে গ্রামেরই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা।’
গ্রামের বাসিন্দা ফ্রান্সিস টোপ্পো বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। এতে গ্রামে উন্নতি হবে। দেশ-বিদেশের মানুষ আসবে।’ বাইরে থেকে আসা পর্যটকরা এখানে এলে পেয়ে যাবেন উত্তরবঙ্গ, ডুয়ার্স, আদিবাসী, বক্সা বিষয়ক বই। আপনকথার সম্পাদক পার্থ সাহা বলেন, ‘আলো ছড়িয়ে দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। সামাজিক বঞ্চনা থেকে উত্তরণের অস্ত্র হতে পারে বই। তাই বইটাই অস্ত্র। আশাকরি পর্যটকদের কাছেও এই গ্রাম আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হবে।’
স্থানীয় পারুল মিঞ্জ বই পড়তে ভালোবাসেন। তাঁর গ্রাম বইগ্রাম হবে জানতে পেরে খুব আগ্রহী। পানিঝোরা প্রাথমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘এতে গ্রামের পড়াশোনার পরিবেশ যেমন আরও প্রসারিত হবে। আর্থসামাজিক ব্যবস্থারও উন্নতি হবে।’