রাজনীতিতে দলবদলের প্রসঙ্গ উঠলে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ কাহিনী আসবেই। বহুলপ্রচলিত শব্দবন্ধনীটি এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। ১৯৬৭ সালে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী নির্দল প্রার্থী গয়া লাল একইদিনে প্রথমে যোগ দেন কংগ্রেসে, তারপর সংযুক্ত মোর্চায়, শেষে ফের কংগ্রেসে। ৯ ঘণ্টায় তাঁর তিন-তিনবার দলবদলের রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। সেই থেকে দলবদলুদের ‘আয়ারাম গয়ারাম’ বলার চল।
সম্প্রতি হলদিয়ার বিজেপি বিধায়ক তাপসী মণ্ডল যেরকম নাটকীয়ভাবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, সেটা চমকপ্রদ। তাপসী সিপিএম ছেড়ে বিজেপির বিধায়ক হন। সম্প্রতি বাজেট অধিবেশন চলাকালীন বিধানসভায় এসে বিরোধী দলনেতার ঘরে বাকি বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে সময় কাটান। তারপর তাঁদের সঙ্গে লাঞ্চ করেন এবং তারপর সোজা তৃণমূল ভবনে গিয়ে নাম লেখান ঘাসফুলে।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় ৭৭ বিজেপি বিধায়ক নির্বাচিত হলেও খসতে খসতে এখন সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৬৫। বিধানসভা ভোটের এখনও বছরখানেক দেরি। ততদিনে সংখ্যাটা আরও কমবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। রাজনীতিতে সততা, দায়বদ্ধতা, আনুগত্যের অত্যন্ত অভাব বলে এই সমস্যা। সিপিএম ছেড়ে বিজেপি, বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল, তৃণমূল থেকে কংগ্রেস, কংগ্রেস থেকে তৃণমূল- দৃষ্টান্ত অজস্র। এ যেন মিউজিক্যাল চেয়ার!
রাজনীতিতে দলবদলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ সৌজন্য ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। বিধানচন্দ্র রায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা ছিলেন জ্যোতি বসু। একদিন বিধান রায়ের অনুপস্থিতিতে জ্যোতিবাবু সরকারপক্ষের মুণ্ডপাত করছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর বিধানবাবু সভায় ঢুকেই তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা গুরুতর অসুস্থ, আমি দেখে এসেছি। তুমি এখনই বাড়ি চলে যাও।’ আবার বহু পরে জ্যোতিবাবু যখন মুখ্যমন্ত্রী, তখন প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এবং সৌজন্যের অজস্র গল্প আছে।
কয়েক বছর আগেও এমন ঘটনা দেখা গিয়েছে। বাবুল সুপ্রিয় তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বাবুলকে দেখেই তাঁর গাড়িতে উঠতে অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌজন্য বজায় রেখে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ওই গাড়িতে ওঠেন। তারপর ভিক্টোরিয়ার সামনে ঝালমুড়ি খান দুজনে। দশ-বারো বছর আগেও শাসক-বিরোধী পক্ষের এই সৌজন্য সম্পর্কের আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
সভার মধ্যে পরস্পরকে আক্রমণে তৃণমূল ও বিজেপি উভয়পক্ষ শালীনতা, শোভনীয়তা ছাড়াচ্ছে। যেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এতে সৌজন্য বলে কিছু থাকছে না। যা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিরাট বাধা। হিন্দু ভোট টানতে কখনও মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান।’ কখনও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ‘তৃণমূলের সংখ্যালঘু বিধায়কদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে।’ তৃণমূলের হুমায়ুন কবীর ও সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীরা আবার মুর্শিদাবাদে ঢুকতে না দেওয়া এবং ঠ্যাং খোঁড়া করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
হুমায়ুনকে অবশ্য দল শোকজ করেছে। সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক শংকর ঘোষের মন্তব্যও। তৃণমূলের কিছু বিধায়কও সভায় এবং বাইরে অপরিষদীয় ও বিদ্বেষমূলক কথা বলছেন। অথচ অভব্য আচরণের অভিযোগে বিরোধী বিধায়কদেরই শুধু সাসপেন্ড করেন অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষের সিদ্ধান্ত সবসময় নিরপেক্ষ থাকে বলা যাবে না। সব মিলিয়ে বিধানসভার পরিবেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকছে না।
অথচ জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব অনেক। তাঁদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। বাকসংযম থাকাও জরুরি। এ রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস। সংবেদনশীল বিষয়ে অনেক ভেবেচিন্তে মুখ খোলা দরকার। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সেই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব চোখে পড়ছে। শাসক-বিরোধী, দু’তরফেই একই সমস্যা। পরিষদীয় রাজনীতির মান নিম্নমুখী। অদূরভবিষ্যতে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটবে, এমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।