শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

কবিতাগুচ্ছ

শেষ আপডেট:

  • শিশির রায়নাথ

 

 

আঙ্কিক

 

সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্ক থেকে আমি যতবার পালাতে চেয়েছি

ততবার কে যেন আমাকে ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়েছে

এক অন্ধকার শ্যাওলাময় ভাঙা সিঁড়ির সামনে

ব্যর্থ ছাত্রের মতো আমি তার জটিল ধাপ

একটিও পার হতে পারিনি কোনওদিন

 

 

প্রকৃতি-প্রত্যয় কিংবা সন্ধি-বিচ্ছেদের কাছেও হতবাক সারাটা জীবন

যতবার লিঙ্গান্তর ঘটাতে যাই কৃষ্ণকলিদিকে মনে পড়ে

ছেলে হতে চেয়ে শেষপর্যন্ত গলায় দড়ি দিয়েছিল সে

তার প্যান্ট-শার্ট পরা শরীরে আমি পৃথিবীর যাবতীয় রাগ ও ঘৃণা

দুলতে দেখেছিলাম সেদিন

 

 

যতই আমাকে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি নির্ভুল শেখানো হোক

আমি কোনদিনও একসাথে তিনটি কোণ আঁকতে পারিনি

তারা ক্রমাগত পাঁচ থেকে আট থেকে দশ হয়ে ভেঙে পড়ত

আমার মুহ্যমান চারপাশে

এত কৌণিক সম্পর্কের ভিতর কোনও নিস্তরঙ্গ সমষ্টির চিহ্ন

আমি বার করতে পারিনি আজও

 

এক হতাশ ফেল করা ছাত্র কিংবা এক উদ্ভ্রান্ত যুবক

অথবা বিপর্যস্ত এক বৃদ্ধের মতো

অনেক বক্ররেখা, গুণিতক ও বন্ধনীর প্যারাবোলিক পথ ধরে

এখন আমি হেঁটে যাচ্ছি সেই জটিল অঙ্কের ভিতর

সরল শূন্যতা ছাড়া

যার আর কোনও নির্ভুল উত্তর নেই…

 

মিথোজীবী

তোমার শরীরে আমার গান

আমার শরীরে তোমার জলের কল্লোল

 

শূন্যতার দিকে ছড়ানো আমার লক্ষ লক্ষ পাতায় পাতায়

তোমার ক্লোরোফিল

তোমার ক্লোরোফিলের ভিতর আমার মুঠো মুঠো রোদ

 

অরণ্য-ক্যানোপি জুড়ে যে গম্ভীর মেঘ ও উষ্ণতা

তা আমাদেরই যৌথ বাষ্প-মোচনের ইতিহাস

 

কত বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা কত রুমাল-চোর বিকেল

কত সেচহীন দুপুর কত জন্মান্ধ রাত

রুগ্ন বালকের মতো শীর্ণ কত শীতকাল

 

তোমার ঘুমহীন প্রহর

আমার স্বেচ্ছাচারী না-লেখা কবিতা

 

শিকড়ে শিকড় জড়িয়ে

কার্বন-বিষণ্ণ এই পৃথিবীতে

 

আমরা আজও লিখে যাচ্ছি আমাদের

সেই অ-লৌকিক উদ্ভিদ-পুরাণ

 

যার ভাষা আছে বর্ণমালা নেই….

 

 

কবি

 

কয়েকটি বুলেট ও একটি ধূসর মৃত্যুর মাঝখানে কবি আবার নিজেকে  দেখতে পায়

 

জং পড়া শহরের সেই শীতার্ত অন্ধকার রাতে যখন ঘণ্টা বাজাবে বলে একটিও গির্জা জেগে নেই

শুধু মার্চিং বুটের শব্দ আর বেবুনের মুখোশ আঁটা সান্ত্রিদের গম্ভীর ধমক-হল্ট…

 

অমনি যত ইঁদুর আর বেশ্যার দালাল, পেডলার, ভাতহীন যৌনকর্মী আর উদ্ভ্রান্ত মাতালের দল

হ্যালোজেন-সভ্যতা থেকে একসাথে সরে যায় গূঢ় অন্ধকারের দিকে

 

তখন বাতাস স্তব্ধ। গাছে গাছে শীতের হিল্লোল।

তখন কুয়াশারা চলে যায় ভুল পথ ধরে

 

শুধু একজন, কবি, রাত জেগে জেগে

সিগারেটের ধোঁয়ার মতো গিলতে থাকে এইসব কূট ও জটিল এনকাউন্টার

 

কয়েকটি রাষ্ট্রীয় বুলেট

জাতীয় সংহতি নিয়ে সাক্ষীহীন ছুটে যায়

সে কবির বুকে…

 

স্থির চিত্র

 

কী দেখব বলে এতদূর এসেছিলাম এখন আর মনে নেই

 

শুধু এক ধপধপে সাদা স্যানাটোরিয়াম

আর কয়েকজন ক্ষয়িষ্ণু মানুষ

এই ম্রিয়মাণ চরাচর জুড়ে

 

তারা যে কোনও এক দৃশ্য তেমনটা নয়

তবু কিছু দেখব ভেবে তো এসেছিলাম

জলের কাছে জঙ্গলের কাছে

নিজেরই লুকিয়ে পড়া নাতিদীর্ঘ ছায়াটির কাছে

যেভাবে আসি প্রতিবার

নিঃস্ব ও অভিমানহীন

 

দু’একটা ক্রিপ্টোমেরিয়া ঝুঁকে পড়েছে খাদের ওপর

গাছ নয়…যেন গোটা স্যানাটোরিয়ামটাই ঝুঁকে পড়েছে আবার

আমার পুরোনো অসুখগুলো নিয়ে

 

যেন তলিয়ে যাবার আগে এক অর্বাচীন স্থিরচিত্র

 

ঠিক এর জন্যই কি এসেছিলাম এত দূর

কে জানে

 

এই চারমাত্রিক চরাচর জুড়ে এখন শুধু

এক পতনোন্মুখ সাদা স্যানাটোরিয়াম

আর আমার সমস্ত অসুখ…

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

সুশীল কুমার থেকে বাদামকাকু, ছবিটা একই

মহুয়া বাউল বড়লোক নিয়ে একটা কথা খুব জনপ্রিয়। ‘তুমি...

গরিব খোঁজে খাদ্য আর ধনী খোঁজে খিদে

অম্বরীশ ঘোষ অনেক বিশিষ্টজনেরাই বিভিন্ন সময় বলেছেন, কিছু কিছু...

সময়ের সঙ্গে সংজ্ঞা বদল

রাহুল দাস মানুষ যখন যাযাবর ছিল, তখন ‘বড়লোক’ শব্দবন্ধটি...

মায়ের কান্না

পিনাকীরঞ্জন পাল ।। এক ।। শালবাগান। নাম শুনলে মনে হয়...