শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

রাজনীতির পরিহাস

শেষ আপডেট:

যেন জরুরি অবস্থার বাৎসরিক পালন। তা-ও আবার গণতন্ত্রের কালো অধ্যায়ের ৫০ বছর পূর্তি। কংগ্রেসকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। আস্ত বই-ই লিখে ফেলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মন কি বাত-এও চর্চায় জরুরি অবস্থা। দেশজুড়ে বিজেপির সেমিনার ইত্যাদিতে বোঝানো হচ্ছে, গণতন্ত্রকে উজ্জ্বল পথে নিয়ে যাওয়ার দিশারি নরেন্দ্র মোদি। যদিও দেশে-বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর নানা কর্মসূচিতে করতালির তালে তালে ‘মোদি মোদি’ ধ্বনি মনে করিয়ে দেয় জরুরি অবস্থাকালীন ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ স্লোগানটিকে।

ভারত কেন পৃথিবীর ইতিহাসেও দেশ ও নেতাকে এক করে দেখানোর সেই স্লোগানের মতো স্বৈরতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা আর কিছু হয় না। সেই ঘটনার অর্ধশতবর্ষ পূর্তিতে বিজেপি একদিকে সেই শাসনের মুণ্ডপাত করছে, অন্যদিকে নিজেদের গণতন্ত্র রক্ষার কান্ডারি হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে। ঘটা করে পালিত হল সংবিধান হত্যা দিবস।

ইতিহাসের পরিহাস এমনই যে, ইন্দিরার পরের দ্বিতীয় প্রজন্ম এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বের লাগাম এখন যাঁর হাতে, সেই রাহুল গান্ধি সংবিধান হাতে ঘুরে বেড়ান। সংসদের ভেতরে তো বটেই। নির্বাচনি প্রচারেও। ব্যতিক্রম নন কংগ্রেসের গর্ভে বিকশিত হয়ে পরে পৃথক দল তৃণমূলের জন্মদাত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রাজত্বে নাগরিক অধিকার পদদলিত হওয়ার ঘটনা কম নয়। কিন্তু তিনিও সংবিধানের ভজনায় ব্যস্ত থাকেন।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও রোজ জরুরি অবস্থার নানা সংস্করণ প্রায়ই উপলব্ধি হয়। যে ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন স্ট্যান স্বামী থেকে শুরু করে উমর খালিদ, প্রবীর পুরকায়স্থ প্রমুখ। এ দেশে রাষ্ট্রদোহ দমনের নামে এখনও যে ‘ইউএপিএ’ আইন টিকে আছে, তা তো ইন্দিরা প্রবর্তিত ‘মিসা’ কিংবা পরবর্তীকালে ‘টাডা’রই নতুন সংস্করণ। যাঁরা গণতন্ত্রের জয়গানে মুখর, তাঁরা কিন্তু ভুলেও কখনও ‘ইউএপিএ’ প্রত্যাহারের পক্ষে সওয়াল করেন না।

যতই সংবিধানের কথা বলা হোক না, বিভিন্ন শাসনে তাকে ব্যবহার করেই নানা স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ করা হয়েছে। জরুরি অবস্থার শাসনে দেশজুড়ে যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল, ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে তা কার্যত বিদ্রোহের আকারে প্রতিফলিত হয় ব্যালট বক্সে। মানুষ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল সংঘ পরিবার। ইন্দিরাকে পর্যুদস্ত করে যে জনতা দল ক্ষমতায় এসেছিল, তার বড় শরিক ছিল জনসংঘ। যে দলটি এখনকার বিজেপির পূর্বসূরি। জনতা দল ভেঙে জনসংঘীরা বিজেপির পত্তন করেছিলেন।

একদা কংগ্রেসি, পরে সমাজতন্ত্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ছাতার তলায় সেই যে জনসংঘীদের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটাই এখনও চলছে ভারতবর্ষে। গান্ধিবাদী জয়প্রকাশ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে হিন্দুত্ববাদী জনসংঘকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে, সংঘ পরিবার জয়প্রকাশের মতো জননেতার ক্যারিশমাকে ব্যবহার করে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে। জরুরি অবস্থায় আরএসএসকে নিষিদ্ধ করেছিলেন ইন্দিরা। জয়প্রকাশের হাত ধরে সেই আরএসএস এল পাদপ্রদীপের আলোয়।

এতে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংঘ পরিবার নিজেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অন্যতম সৈনিক হিসাবে নিজেদের দেখানো শুরু করতে পেরেছিল। ফলে কংগ্রেস বিরোধী অন্যতম শক্তি হয়ে দেখা দিল জনসংঘ ও পরে বিজেপির বকলমে সংঘ পরিবার। কিন্তু জয়প্রকাশ নারায়ণের সংশ্রব সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভোল বদলাতে পারেনি। উলটে পায়ের তলার মাটি শক্ত হওয়ার পর বিজেপি হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে আরও আঁকড়ে ধরেছে।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নাম করে শুরু হওয়া সেই অভিযানের এখনকার চেহারা স্পষ্ট। জনমতের তোয়াক্কা না করে নানা পদক্ষেপ ও বিরোধী মতের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে এখন নিয়ম হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তেমন ভেদ নেই। যে দল যেখানে ক্ষমতায়, সেখানেই নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকে। ফলে সংবিধান হত্যা দিবস পালন গণতন্ত্রের মৃত্যুতেই একধরনের সিলমোহর দিচ্ছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

রাজনীতিতে অবসর

সমস্ত শুরুর একটা শেষ থাকে। অনন্তকাল ধরে সবকিছু একইভাবে...

রাজনীতির শত্রুমিত্র

রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বলে কিছু হয় না।‌ সে বন্ধুত্বই হোক...

নিশানায় যখন নাগরিক

রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক সবসময় মসৃণ থাকে না। তবে...

অস্থিরতাও কৌশল

আমেরিকা এখন এক নতুন রাজনীতির সাক্ষী। যাকে নীতি বা...