- সানি সরকার
কোথাও রাস্তা ওপর দিয়ে জল বইছে, কোথাও আবার একের পর এক বাড়ি গিলেছে তিস্তা। পরিচিত তিস্তাকে অপরিচিত লাগছে পাহাড় থেকে সমতলে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল সাউথ লোনাক লেক বিপর্যয়ের পর। সবুজ রংটাও হারিয়েছে গিয়েছে জল থেকে।
তিস্তাগর্ভে রীতিমতো বিপদঘণ্টা। বিপদ পাহাড়ের খাঁজেও। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই ধসে পড়ছে একের পর এক বাড়ি। এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু ঘটছে ৯ জনের। আহতর সংখ্যা নিয়ে কোনও পরিসংখ্যান নেই সিকিম প্রশাসনের কাছে বা তথ্য সামনে আনা হচ্ছে না।
যেমনটা গোপন রাখা হচ্ছে কত বাড়ি এবং মানুষ এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে মংগনে অতিভারী বৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা। কিন্তু বর্ষার সময় তো উত্তর সিকিমে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি স্বাভাবিক। মংগনে যে বৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে, তার মধ্যে তো অস্বাভাবিকতা কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না আবহবিদরা। যে কারণে সামনে আসে সাউথ লোনাক লেক বিপর্যয়ের জেরে তিস্তায় পলির স্তর এবং নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার বিষয়টি।
নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় না হয় সিকিম থেকে উত্তরবঙ্গের বড় একটা অংশে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায়। কিন্তু স্বাভাবিক এমন বৃষ্টিতে কীভাবে হুড়মুড়িয়ে পাহাড় ভেঙে পড়ছে? কেন মংগন বিপদের জন্মভূমি হয়ে উঠেছে?
উত্তর খুঁজতে গেলে যেতে হয় এক দশক পিছনে। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। ঘড়ির কাঁটা সন্ধে ৬টা ১০-এর ঘরে প্রবেশ করামাত্রই কেঁপে উঠেছিল সিকিম। তীব্র কম্পন (রিখটার স্কেলে ৬.৯) ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা কনজারভেশন এরিয়াকে। উত্তরবঙ্গ তো বটেই, ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশকে। কাঠমান্ডুতে থাকা ব্রিটিশ দূতাবাসের দেওয়াল ভেঙে তিনজন সহ মৃত্যু ঘটেছিল ১১ জনের। জখমের সংখ্যা কয়েকশো।
কিন্তু এই ঘটনার থেকে কোনও শিক্ষা নেওয়া হয়নি। সময় যেমন সামনের দিকে এগিয়েছে, তেমনই স্মৃতির পাতায় ফিকে হয়েছে ওই ঘটনা। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ১৩ বছর হতে চললেও জিওলজিক্যাল সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হয়নি। সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ্যে না আসায় স্পষ্ট নয়, বিশেষজ্ঞরা কী কী পরামর্শ দিয়েছিলেন বা তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ করা হয়েছে সে ব্যাপারে। রিপোর্ট প্রকাশ্যে না আসাতেই আদৌ কোনও সমীক্ষা করা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে অনেকের মনেই। রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হলেও নির্মাণকাজ কিন্তু থেমে নেই। পর্যটনকে গতি দিতে একের পর এক বহুতল মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ঝোরাগুলির মুখ বন্ধ হয়েছে নানাবিধ নির্মাণে। ফলস্বরূপ ভূকম্পনে ভিত নড়ে যাওয়া মংগনে বৃষ্টি হলেই তা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে উত্তর সিকিমকে।
২০০৭ সালের বন্যা থেকেও কিন্তু কোনও শিক্ষা নেওয়া হয়নি। ’০৭-এর তিস্তার ভয়ংকর হয়ে ওঠা এবং ’১১-র ভূকম্পনের পর অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকেই দায়ী করেছিলেন বিশেজ্ঞরা। তিস্তার গতিপথ রুখে দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার মাশুল যে সিকিমের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গকে দিতে হবে, দুটি ঘটনাকে সামনে রেখে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু কী দেখা যাচ্ছে? ২০০৭-এর বন্যায় তিস্তাতে মিশেছিল ২৭ মাইলে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভিত। কিন্তু সেই তিস্তাকে বেঁধে ২০১২-তে চালু করে দেওয়া হল ২৭ মাইলের জলবিদ্যুৎকেন্দ্র।
একইরকম ভাবে নর্থ ইস্টার্ন সোসাইটি ফর প্রিজারভেশন অফ নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ (নেসপন), উত্তরবঙ্গ বনজন শ্রমজীবী মঞ্চ, হিমালয়ান ফরেস্ট ভিলেজার্স অর্গানাইজেশনের লড়াই, আন্দোলনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ’১৫-’১৬-তে বিদ্যুৎ উৎপন্ন শুরু হয়ে যায় কালিঝোরা থেকে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সরকারিভাবে ’০৭-এর বন্যার কারণ অনুসন্ধানই হয়নি।
সেবক-রংপো রেলপ্রকল্পের ক্ষেত্রে কি ঠিকঠাক সার্ভে হয়েছে? সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করেই প্রকল্পটির কাজ শুরু করা হয়েছে বলে রেলের দাবি। কিন্তু হিমালয়ান রিজিয়ন যখন ভঙ্গুর, তখন প্রকৃতির সমস্ত শর্ত মানলে এই অঞ্চলে কখনোই এই ধরনের প্রকল্প হতে পারে না বলে মত পরিবেশপ্রেমীদের। যা নিয়ে তাঁরা দীর্ঘ বছর আন্দোলন করেছেন। কিন্তু ওই আন্দোলনের জেরে ২০০৯-এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও, পুরোদমে কাজ শুরু হতে লেগে যায় ৯টি বছর। ২০১৮-তে প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে টানেলের পরিধি যত বেড়েছে, ততই স্পষ্ট হয়েছে প্রকল্পটির পথের এলাকা বা পাহাড় কতটা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বারবার ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে ১১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ’২৫-র ১৫ অগাস্টকে লক্ষ্য রেখে কাজের গতি বাড়িয়েছে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (ইরকন)। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রংপো স্টেশনের শিলান্যাস হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তিস্তাবাজার স্টেশনটি উদ্বোধন হতে চলেছে। রংপো-মাঝিটার এবং তিস্তাবাজার, দুটি অঞ্চলের মানুষের বক্তব্য, রেলপ্রকল্পটির জন্য মাসের পর মাস তাঁরা কার্যত নিদ্রাহীন। এই মনে হয় সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, আতঙ্কে সময় কাটে টানেলের পাশে থাকা পাহাড়ি গ্রামগুলির।
এরই মধ্যে ৪ অক্টোবর সাউথ লোনাক হ্রদ বিপর্যয় বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে তিস্তাকে। তিস্তাও তার জলধারণ ক্ষমতা হারিয়ে বিপদ ডেকে আনছে হাজার হাজার মানুষের। ১৮৯৯ সালে ২৮ ইঞ্চি বৃষ্টিতে অস্বাভাবিক জলস্তর বেড়েছিল তিস্তায়। যার জেরে রাস্তা থেকে তিনশো ফুট নীচে থাকা সত্ত্বেও তিস্তাগর্ভে চলে গিয়েছিল সমস্ত কিছু। এখন ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে কতটা নীচে রয়েছে তিস্তা? সহজ উত্তর সামান্য।
মংগনের ২২.৮ সেন্টিমিটার বৃষ্টিতে যদি এমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে পরিস্থিতি, তবে ২৮ ইঞ্চি বৃষ্টি হলে কী হবে? তাই তো পাহাড়ের এখন প্রশ্ন, মানুষই যদি না থাকে তবে এত উন্নয়ন কাদের জন্য?