• দীপ সাহা

তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ছে একেকটা বাড়ি। ঝোরাগুলোও আর ঝোরা নেই। যেন একেকটা নদী। পলিতে রুদ্ধ ঝোরার বুক থেকে তাই জল উপচে পড়ছে বড় রাস্তায়। আক্ষরিক অর্থেই যেন সব হয়ে উঠেছে ‘পাগলা ঝোরা’।

উত্তর সিকিমের মঙ্গন থেকে শুরু করে ইয়াংগন, সর্বত্রই এক ছবি। রাস্তা ধসে গিয়ে কোথাও যাতায়ত বন্ধ কোথাও আবার বসতি গিলছে নদী। বর্ষার শুরুতেই এমন ভয়াবহ ছবি দেখে শিউরে উঠছে গোটা সিকিম। লাচুং, চুংথাংয়ের মতো জায়গায় এখনও আটকে হাজারেরও বেশি পর্যটক। না আছে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ, না টেলিফোন পরিষেবা। কবে ঘরে ফিরবেন তাঁরা তাও জানেন না। কিন্তু তাতে কী! বাঙালি আছে বাঙালি হয়েই।

পরশু সকালেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভ্রমণ গ্রুপে দেখছিলাম, বারাসতের এক ভদ্রলোক জুলাইতে সপরিবার সিকিম যাবেন বলে খোঁজখবর করছেন। দু’পক্ষ সেখানে দু’রকম মত দিচ্ছেন। একপক্ষর মতের সারমর্ম যা দাঁড়ায়, ‘এই মুহূর্তে সিকিম যাবেন না। ভয়ংকর অবস্থা ওখানে।’ আরেকপক্ষর যুক্তি, ‘মিডিয়া সবসময় সবকিছু বাড়িয়ে দেখায়। এই তো আমরা ঘুরে এলাম। আপনিও যান।’ অর্থাৎ একদিকে যেমন সাবধানবাণী আছে, তেমনই আছে হুজুগ জোগানোর লোক। আপনি এবারে কোনদিকে যাবেন আপনার ব্যাপার। সতর্কবার্তা শুনে ঘোরার বিকল্প পরিকল্পনাও করতে পারেন অথবা হুজুগে বিপদেও পড়তে পারেন।

সমস্যা হল, সিকিমে এত পর্যটক আটকে থাকলেও সেখানকার সরকার কখনোই বলবে না, ‘দয়া করে এখন সিকিমে আসবেন না।’ টাকা যে বড় বালাই সেটা আমজনতা যেমন তেমন, সরকার বেশ ভালোই জানে। তাই যতই রাস্তা ধসে যাক, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক, পর্যটকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার আগে দু’বার ভাববেন না ক্ষমতা দখল করে থাকা কেষ্টবিষ্টুরা।

পবন চামলিংয়ের সিকিম ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টকে কার্যত ধূলিসাৎ করে দিয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেছেন সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চার প্রেমসিং তামাং (গোলে)। দীর্ঘদিন মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলানোয় সিকিমের হালহকিকত তাঁর অজানা নয়। কিন্তু গত অক্টোবরে লোনাক হ্রদ বিপর্যয়ের পর পর্যটকদের সিকিম যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে যেভাবে পর্যটন ব্যবসায়ীদের থেকে মুখঝামটা খেতে হয়েছে তাঁর সরকারকে, তাতে ওই পথ আর তিনি মাড়াবেন বলে মনে হয় না। বিপদটা আসলে এখানেই।

সিকিম সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-২০২৪ সালের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক বিদেশি পর্যটক পা রেখেছেন পাহাড়ি রাজ্যটিতে। সংখ্যাটা প্রায় ৭ লক্ষ। হ্রদ-বিপর্যয়ের পর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা সিকিমের পর্যটনের ঘুরে দাঁড়াতে তাই সময় লাগেনি। কারণ চলতি বছরেই এখনও পর্যন্ত ৩৩,৮৬৪ জন বিদেশি পর্যটক সিকিম ঘুরে গিয়েছেন। সংখ্যাটা যে গত কয়েকদিনে আরও কিছুটা বেড়েছে তা সহজেই অনুমেয়। এ তো গেল বিদেশি পর্যটকের কথা। আর দেশি পর্যটক! সরকারি হিসেবে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও গত মে মাসে পর্যটনের ভরা মরশুমেই শুধু সেখানে পা রেখেছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ পর্যটক। হ্রদ বিপর্যয়ের পর থেকে সেই সংখ্যাটা প্রায় ১৫ লক্ষ ছুঁইছুঁই। ফলে এক বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমনে সিকিমের অর্থনীতি যে চড়চড়িয়ে বেড়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

লোনাক বিপর্যয়ের পর তিস্তায় পলি জমে যে বিপদ দাঁড়িয়ে আছে, তা আগেই বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয় বরফভাঙা জল উপচে পড়ে পলি জমেছে প্রতিটি ঝোরার বুকেও। কিন্তু সেগুলি সংস্কারে এক পাও বাড়ায়নি সিকিম সরকার। সেনার সাহায্যে রাস্তাঘাট, সেতু তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গোড়ার গলদ মেটাতে রাজ্য বা কেন্দ্র কোনও সরকারই উদ্যোগী হয়নি। চলতি বছরের শুরুর দিকে তিস্তার পূর্ণ সংস্কারে ২০,০০০ কোটি টাকা চেয়ে কেন্দ্রকে রিপোর্ট দিয়েছিল গোলে’র সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে ভোটের রাজনীতিতে সেই রিপোর্ট কার্যত ভেসে গিয়েছে তিস্তার জলে। কথা হচ্ছিল সিংতামের বাসিন্দা দীপক ছেত্রীর সঙ্গে। তিনি বলছেন, ‘হ্রদ বিপর্যয়ের পর সিকিম সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে যে কাজ করার দরকার ছিল, সেগুলো হয়নি।’

১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সিকিম যাওয়ার পথে নীলরঙা তিস্তাকে দেখে প্রেমে পড়তে পারতেন যে কোনও ভ্রমণ প্রেমিক। কিন্তু সেই তিস্তাই যে ধূসররঙা হয়ে এমন ভয়াল ভয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে তা আঁচ করা যায়নি কোনওদিন। এ যেন এক অচেনা তিস্তা।

লোনাকের বিপর্যয়ের পর আলোচনায় উঠে এসেছে হিমবাহ গলতে থাকার বিষয়টি। এখানেই আরও আশঙ্কার কথা শোনাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সিকিমের হ্রদ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা পর্বতারোহীদের একটি দলের রিপোর্ট বলছে, লোনাক ছাড়াও আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহী হ্রদ রয়েছে উত্তর সিকিমে। তারমধ্যে তিস্তা খংতসে হিমবাহের কাংচুং চো যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। হ্রদটি গত ৪০ বছরে ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। ফলে লোনাকের মতো বিপর্যয় যে এখানেও ঘটতে পারে, তার আঁচ রয়েছে। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান গুরুদংমার লেকটিও বিপজ্জনক বলে দলটি ইঙ্গিত দিচ্ছে।

লোনাকের মতো বিপর্যয় যদি এই দুটি হ্রদেও ঘটে, তাহলে সুন্দরী তিস্তা যে আরও ভয়ংকরী হয়ে উঠবে তা নিশ্চিত। কারণ তিস্তা খংতসে বা তিস্তা খংসে হিমবাহ থেকেই উত্পত্তি পাহাড়ি নদীটির। সেক্ষেত্রে লোনাকের থেকে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলাই যায়।

মজার কথা হল, লোনাকে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে, তার ইঙ্গিত আগে থেকেই ছিল। সিকিম সরকারও তা জানত। কিন্তু বিপর্যয় রুখতে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি সরকার। তিস্তা খংতসে বা গুরুদংমারের বর্তমান কথাও অজানা নয় সরকারের। কীভাবে বিপর্যয় এড়ানো যেতে পারে, তার প্রাথমিক একটি রূপরেখাও সরকারের ঘরে জমা পড়েছে। সেখানে মোরাইন বাঁধকে শক্তিশালী করা, হিমবাহী হ্রদের জন্য নিয়ন্ত্রিত নিষ্কাশন ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্তারা সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে আশু ব্যবস্থা নিয়েছেন বা নেবেন কি না তা কেউ জানে না।

ঘুম ভাঙলে সিকিমকে বাঁচাতে একজোট হবে তো কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, নাকি কেবল পর্যটকদের থেকে মুনাফা লোটাই লক্ষ্য থাকবে? প্রশ্নচিহ্নটা বড় হয়ে দাঁড়ায় তিস্তাপারে।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

দুই টোটোচালক সংগঠনের মারামারি, উত্তেজনা গাজোলে

গাজোল: কয়েকদিন ধরে দুই শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে চলছিল বিরোধ। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ছোটখাটো হাতাহাতির…

3 hours ago

কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা নাবালকদের অ্যাকাউন্টে? ভিত্তিহীন অভিযোগ বলছে প্রশাসন

হরিশ্চন্দ্রপুর: কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা ঢুকছে নাবালকদের অ্যাকাউন্টে। হরিশ্চন্দ্রপুরের ইসলামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে এমন অভিযোগ সামনে…

3 hours ago

Siliguri | ভাগ্নের পেটে কাঁচি ঢুকিয়ে খুনের চেষ্টা! শ্রীঘরে মামা

শিলিগুড়ি: ভাগ্নের পেটে কাঁচি ঢুকিয়ে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠল মামার বিরুদ্ধে। রবিবার বিকেলে পুরনিগমের ২৮…

3 hours ago

Mujnai river | মাছ ধরতে নদীতে নেমে তলিয়ে গেল যুবক, উদ্ধার করতে এসে আক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সদস্যরা

ফুলবাড়ি: নদীতে তলিয়ে যাওয়া যুবকের খোঁজে তল্লাশি চালাতে এসে স্থানীয়দের হাতে আক্রান্ত হলেন ক্যুইক রেসপন্স…

3 hours ago

Sexually harassing | প্রেমের প্রস্তাবে মেলেনি সারা, ক্ষোভে ভাগ্নিকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ উঠল মামার বিরুদ্ধে

কালিয়াগঞ্জঃ এক অবিবাহিত ভাগ্নির প্রেমে পাগল পাড়াতুতো বিবাহিত মামা। এমন প্রেমে সারা না দেওয়ায় ক্ষোভে…

4 hours ago

Nagrakata | বিধানসভার ফলে নাগরাকাটায় এগিয়ে তৃণমূল, পিছিয়ে বিজেপি, বিশ্লেষণে শামিল দু’পক্ষই

নাগরাকাটা: আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের সবকটি বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস পিছিয়ে থাকলেও একমাত্র অক্সিজেন নাগরাকাটা। অন্যদিকে লোকসভার…

5 hours ago

This website uses cookies.