উত্তর সম্পাদকীয়

টমকে নকল করতে গিয়ে হারিয়ে যায় তিন দামাল

 

  • শেখর বসু

হ্যানিবলের গুহা। সে গুহার আলো-আঁধারিতে ঘণ্টাখানেকের সফর সেরে বাইরে বেরিয়েছি। তখনও টমদের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার মধ্যে।  আসলে ছোট্ট বন্দর-শহরটার সর্বত্রই টম, হাক আর বেকিরা। চমকপ্রদ ওই গল্পের আকর্ষণ কখনো-কখনো যে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার একটি প্রমাণ পেলাম কাছের পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে।

পাহাড়ের একপ্রান্তে পাথরের একটি ফলক। কীসব যেন খোদাই করা আছে ওখানে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সেই লেখাটা পড়ে চমকে উঠেছিলাম ভীষণভাবে। এমনও হয়!

তিনটি অল্পবয়সি ছেলে টমদের আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী পড়ে মুগ্ধ হয়ে সত্যি সত্যি অ্যাডভেঞ্চার করতে এসেছিল এখানে। টম আর হাক যে পথে যেভাবে গিয়েছিল, সেই পথে সেইভাবে ওরাও যাবে। ছেলে তিনটির নাম ক্রেগ ডোয়েল, জো হোগ আর বিলি হোগ।

অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তিনটি বালক পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৬৭ সালের ১০ মে। তারপর তারা আর ফিরে আসেনি। তাদের সন্ধানে তিনটি উদ্ধারকারী দল বেরিয়েছিল। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল শেষপর্যন্ত। কোনও হদিসই পাওয়া যায়নি ওদের। মর্মাহত হয়েছিল সবাই। দামাল ছেলে তিনটির প্রতি সব মানুষের প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা লেখা হয়েছে পাথরের ফলকে।

বড় লেখকদের হাতে অত্যাশ্চর্য কল্পকাহিনীও বোধহয় নতুন মাত্রা পেয়ে থাকে। লেখার গুণে সে কাহিনী প্রত্যেকের কাছেই সত্যি বলে মনে হয়। সত্যিকে আরও সত্যি বানাবার জন্য অল্পবয়সিরা অনেক সময় বাড়তি একটা উদ্যোগও নিয়ে থাকে।

জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার ট্রাভেলস’ বেরোবার পরে ইংল্যান্ডের অনেক ছেলেমেয়ে লিলিপুটদের দেশ খুঁজে বার করার জন্যে পৃথিবীর মানচিত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিয়েছিল। আফ্রিকা আমাদের দেশ থেকে বড্ড দূরে। নাহলে বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ার পরে অল্পবয়সি বাঙালি ছেলেদের কেউ কেউ হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে ওই পাহাড়ের পথে রওনা হয়ে যেত।

এক আশ্চর্য মায়াময় শহর হ্যানিবল। বাস্তবের সত্যি আর গল্পের মিথ্যে এখানে একাকার হয়ে গিয়েছে। লেখক মার্ক টোয়েন সত্যি, সত্যি তাঁর ছেলেবেলার বাসভূমি। ছোট্ট এই শহরের মানুষেরা সুদীর্ঘকাল ধরে গভীর মমতার সঙ্গে লেখকের বিভিন্ন স্মারক সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন। করা স্বাভাবিক। এতবড় একজন লেখক, যাঁর খ্যাতি জগৎজোড়া, তাঁর প্রতি তাঁর ছেলেবেলার শহরের মানুষেরা দুর্বল তো হবেনই। তবে অবাক কাণ্ড, গল্পের বেশ কিছু চরিত্রের আসল পরিচয় ও বাড়িঘরও আবিষ্কার করে ফেলেছেন তাঁরা।

এই বইটির বেশিরভাগ কল্পচরিত্রেরই একটি করে প্রোটোটাইপ ছিল। আসলে সেই মানুষগুলির গায়ে বিস্তর রং লাগিয়ে গল্পের বইয়ের পাতায় তাদের জায়গা দিয়েছেন লেখক। আস্তে আস্তে ওইসব কাল্পনিক চরিত্রের আড়ালের আসল মানুষগুলিকে চিনে ফেলেছিলেন গ্রামের লোকরা। এই যেমন—ওটা হাকলবেরি ফিনের ডেরা, এই বাড়িটা বেকি থ্যাচারের। কাছেই মার্ক টোয়েনের ছেলেবেলার বাড়ি। লেখকের সঙ্গে টম স্যয়ার মিশে আছে অনেকখানি। সুতরাং টমের ঘর কোনটা—চিনে ফেলা সহজ।

টোয়েনের বাড়ির পাশে মস্তবড় একটা বেড়া আছে। টমের বেড়া রং করার সুবাদে এটিও এখন ঐতিহাসিক। প্রায় দুশো বছর আগেকার সামান্য একটা বেড়ার পক্ষে অক্ষয় হওয়া কঠিন। কিন্তু ঠিক অমনই একটি বেড়া বানিয়ে গল্পের ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। পর্যটকরা এই বেড়াটিও অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে থাকেন।

অতি সাধারণ একটি বেড়া কেন এত বিখ্যাত জানার জন্যে টম স্যয়ারের গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়া যেতে পারে আরেকবার।

গল্পের টম সেদিন রাস্তায় বেরিয়ে দেখে, একটা ছেলে দারুণ সাজগোজ করে ডাঁটিয়ালের মতো হাঁটছে। ছেলেটার রকমসকম একেবারেই ভালো লাগেনি টমের। হঠাৎ ওর মনে হল—ছোকরাকে ধরে পেটালে কেমন হয়!

সাধু মতলব। কিন্তু এমনি-এমনি তো কাউকে আর মারা যায় না! একটা কারণ থাকা দরকার। গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধিয়ে সেই কারণটা খুঁজে বার করেছিল দস্যি টম। ব্যাস, তারপরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মারামারি।

মারামারির পরে টম ঠিক করল— রাত্তিরবেলা সোজা পথে বাড়ি ফেরা ঠিক হবে না। পলিমাসির ভয়ে জানলা গলে ঘরে ঢুকছিল। কিন্তু কপাল খারাপ ওর, ঘরে ঢুকতেই মাসির মুখোমুখি। টমের চোখমুখের চেহারা আর জামা-প্যান্টের অবস্থা দেখে মাসির বুঝতে বাকি থাকল না—ছেলে কী কাণ্ড করে ফিরেছে!

পরদিন ছিল টমদের স্কুলছুটির দিন। ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে সকাল হতে না হতেই মাসি হুকুম দিলেন— আজ আর একদম খেলাধুলো নয়, তুমি বাড়ির সামনের ওই বেড়াটা রং করবে।

হুকুম শুনে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল টমের। ন-ফিট উঁচু আর ত্রিশ ফুট লম্বা বেড়া রং করা কি চাট্টিখানি কথা!

কিন্তু মাসির আদেশ অমান্য করার সাধ্য ছিল না ওর। রঙের কৌটো আর ব্রাশ নিয়ে কাজে হাত লাগিয়েছিল টম। বেড়ার গায়ে একটু করে রং লাগায় আর চোখ ফেটে জল এসে যায় ওর। ইশ! এই রকম চমৎকার একটা ছুটির দিন মাঠে মারা গেল। একবারের জন্যেও খেলতে যাওয়া যাবে না!

বাড়ির কাজের ছেলে জিম হাতে বালতি ঝুলিয়ে জল আনতে যাচ্ছিল। টম ওকে রঙের কাজে জুড়ে দেওয়ার জন্যে বলেছিল, জিম তুই যদি আমার হয়ে বেড়াটা একটু রং করে দিস, আমার সাদা মার্বেলটা তোকে দিয়ে দেব।

লোভে পড়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল জিম, কিন্তু হঠাৎ দূরে পলিমাসিকে দেখতে পেয়ে বালতি নিয়ে ছুট লাগিয়েছিল ওখান থেকে।

বেচারা টম। মন খারাপ করে বেড়ার গায়ে রং লাগাতে শুরু করেছিল আবার। একটু বাদে মস্ত একটা আপেল খেতে খেতে ওখানে হাজির হয়েছিল বেন রজার্স। বেন টমের সমবয়সি। ঠাট্টা করে ও টমকে বলল, বেশ হয়েছে! ছুটির দিনের সব খেলাধুলো বন্ধ। বেড়া রং করে যাও এবার সারাদিন ধরে।

বিচ্ছু ছেলে টম। বিস্তর বুদ্ধিও ধরে মাথায়। বেনকে দেখেই ওর মাথায় একটা মতলব খেলে গিয়েছিল। বিরাট এক শিল্পীর কায়দায় ও একটু একটু করে রং লাগায় বেড়ায়, তারপর দূরে গিয়ে তারিফ করার ভঙ্গিতে দেখে। তাই দেখে বেন ভেবে বসল—বেড়া রং করাটা না জানি কী দারুণ কাজ! ও টমকে বলল, তুই আমাকে একটু রং করতে দিবি?

বেন টোপ গিলেছে দেখে টম মনে মনে খুব খুশি, কিন্তু চোখেমুখে ভারিক্কি চাল ফুটিয়ে বলল, পাগল! এ কাজ সবাই পারে না।

তাই শুনে বেনের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল আরও। ও কাকুতিমিনতি করার গলায় বলল, একটুখানি রং করতে দে না, আমি তোকে আমার আপেলটা দিয়ে দেব।

চোখেমুখে অনিচ্ছার ভাব ফুটিয়ে টম রাজি হয়েছিল শেষে। বেন চড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মহানন্দে বেড়া রং করতে শুরু করে দিল। ওদিকে গাছের ছায়ায় বসে মুখ টিপে হাসতে হাসতে আপেল খেয়ে যাচ্ছিল টম।

একই কায়দায় টম বোকা বানিয়েছিল বিলি ফিশার, জনি মিলার এবং আরও অনেকগুলো ছেলেকে। বেড়া রং করার ‘দুর্লভ’ সুযোগ দেওয়ার জন্যে টম ওই ছেলেগুলোর কাছ থেকে অনেক উপহার পেয়েছিল। যেমন ঘুড়ি, বারোটা মার্বেল, নীল কাচের টুকরো, চক, কুকুরের গলার কলার, ছুরির ভাঙা বাঁট, অকেজো চাবি ইত্যাদি ইত্যাদি।

দেখতে দেখতে পুরো দু-কোট রং পড়ে গিয়েছিল অতবড় বেড়াটার গায়ে। তারপরেই টম বাহাদুরি নেওয়ার জন্যে ছুটেছিল মাসির কাছে।

টম স্যয়ারের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীতে এ এক অসাধারণ দৃশ্য। টম তো লেখক নিজেই। সুতরাং, ওঁর বাড়ির সামনের মস্ত বেড়াটা টমের বেড়া হয়ে উঠতে বাধা কোথায়। লেখকের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে সামনের ওই বেড়াটিও বহুদিন ধরে দ্রষ্টব্যের তালিকায় পড়ে। আমার মতো কেউ কেউ ওই বেড়ার গায়ে একটুখানি হাত বুলিয়ে নিয়েছিল।

প্রতি বছর জুলাইয়ের দুই, তিন, চার তারিখে হ্যানিবলে টম স্যয়ার দিবস উদযাপিত হয়। সেই উৎসবের একটি বড় আকর্ষণীয় দিক হল বেড়া রং করার প্রতিযোগিতা। উৎসবের অন্যান্য অংশে থাকে টম অ্যান্ড বেকি কনটেস্ট, টমবয় স্যয়ার কম্পিটিশন, নাচ-গান-খেলাধুলো ইত্যাদি।

মার্ক টোয়েনের আমলের সাজগোজ অনেকখানিই ধরে রেখেছে হ্যানিবল। তবে সব আসল জিনিসের সন্ধান মেলে মার্ক টোয়েন মিউজিয়ামে। টোয়েন পরিবারের অনেককিছুই সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখানে।

লেখকের রচনাবলির যাবতীয় প্রথম মুদ্রণ পাওয়া যায় এখানে। আছে ‘দি অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টম স্যয়ার’-এর হাতে লেখা কপি।

জাদুঘরের কাছেই মিসিসিপি। এই নদীটিকে নিয়ে মার্কিন সাহিত্যে কম লেখালেখি হয়নি, কিন্তু টোয়েনের লেখা ছাড়া আর কোথাও বুঝি এতখানি রহস্যময় হয়ে উঠতে পারেনি মিসিসিপি। টম আর হাকের কল্পজীবনকে মাত্রাছাড়া করার পেছনে এই নদীটির মস্ত অবদান। নদীতে তখন বেশ কিছু স্টিমবোট চলত। যাত্রীবাহী, মালবাহী। দু’ধারে ছিল ঘন সবুজ বন। আঁধার রাতে স্টিমবোটের বাঁশির তীক্ষ্ণ আওয়াজ অ্যাডভেঞ্চারের নেশা জাগিয়ে তুলত দুটি দামাল ছেলের মধ্যে।

মিসিসিপির বুকে বহু সময় কাটিয়েছেন লেখক। হ্যানিবলে এলে এই নদী-ভ্রমণে একবার যেতেই হবে। নস্টালজিক রিভারবোটের ব্যবস্থা আছে চমৎকার। আমরা যে বোটটায় চেপেছিলাম, সেটার নাম ‘মার্ক টোয়েন’। সাদা রংয়ের সুদৃশ্য তিনতলা নৌকো।

আজকের এই শহরে সেদিনের ওই বিখ্যাত লেখক আর তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের নামের ছড়াছড়ি। রিভারবোটের নাম মার্ক টোয়েন, কয়েকটা হোটেলের নামও লেখকের নামে। টম আর হাকের নামে কত যে প্রতিষ্ঠান আছে তার আর ইয়ত্তা নেই। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর ওই যে ভয়ংকর খুনে ইনজুন জো—নামকরণের তালিকা থেকে ওকেও বাদ দেওয়া হয়নি।

এ এক আশ্চর্য জগৎ। যার টানে এই প্রজন্মের শিশুরাও স্বপ্ন দেখে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়রা বেরিয়ে পড়ে নতুন কোনও দেশ দেখার খোঁজে।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Road closed due to Landslide | ধসের জেরে বন্ধ পাহাড়ের একাধিক রাস্তা, দুর্ভোগ চরমে

শিলিগুড়ি: ভোগান্তির যেন শেষ নেই পাহাড় পথে। বর্ষণের জেরে বন্ধ ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। এর…

49 mins ago

Cristiano Ronaldo bursts into tears | পেনাল্টি মিস করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পেনাল্টি মিস করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। এমনই দৃশ্য দেখা…

1 hour ago

EURO 2024 | স্লোভেনিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: স্লোভেনিয়াকে টাইব্রেকারে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে ইউরো কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেল…

2 hours ago

অনুমতি ছাড়া ভিডিও ভাইরাল করায় পুলিশের দ্বারস্থ চোপড়ার নির্যাতিতা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: অনুমতি ছাড়া নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল করায় পুলিশের দ্বারস্থ হলেন চোপড়ার নির্যাতিতা।…

12 hours ago

Siliguri | প্রধান থেকে আধিকারিক কেউই নেই! পঞ্চায়েত অফিসে অচলাবস্থা

মিঠুন ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: তীব্র অচলাবস্থা চালু হয়েছে শিলিগুড়ির (Siliguri) ফুলবাড়ি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতে। বর্তমানে পরিষেবা নিতে…

14 hours ago

Jalpaiguri | সরকারি জমি জবরদখল রুখতে বসল সাইনবোর্ড

নাগরাকাটা: পড়ে থাকা সরকারি জমিতে (Govt Land) সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেল জলপাইগুড়ি…

14 hours ago

This website uses cookies.