ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে তাঁদের প্রথম ম্যাচে অপ্রত্যাশিতভাবে বাংলাদেশের কাছে পরাজয় প্রচণ্ড চাপে ফেলে দিয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়দের। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে সেবার গ্রুপ লিগ খেলেই বিদায় নেয় ভারত।
সেদিন রাতে ভারতীয় টিম হোটেলে গিয়ে দেখেছিলাম শুনসান লবি, অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা হোটেলজুড়ে। নিজেদের ঘরে আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন শচীন এবং সৌরভ। হোটেল থেকে বের হতেই চোখে পড়ল সামনের রাস্তায় পায়চারি করছেন অধিনায়ক দ্রাবিড়। নিঃসঙ্গ। থমথমে মুখ। এতটাই বিধ্বস্ত লাগছিল যে, এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারিনি।
দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই অধিনায়কের দায়িত্ব ছেড়ে দেন রাহুল। সৌরভের মতো সাহসী, আগ্রাসী অধিনায়ক হয়ে উঠতে পারেননি রাহুল। দলের তরুণদের অনুপ্রাণিত করার বিশেষ ক্ষমতা ছিল মহারাজের। আর যে কোনও পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে ম্যাচ বের করে নিতে পারতেন ধোনি। তিনিই একমাত্র ভারতীয় যাঁর নেতৃত্বে একদিনের এবং টি২০ বিশ্বকাপ জেতে টিম ইন্ডিয়া। অধিনায়ক দ্রাবিড় ওঁদের দুজনের মতো সফল না হলেও ২৫টি টেস্টে আটটি এবং ৭৯টি একদিনের ম্যাচে ৪২ জয় যথেষ্ট প্রশংসনীয়।
সাফল্যের গড়ে আজহার, কপিল, গাভাসকারদের পিছনে ফেলে দেন রাহুল (৪৮.০৭)। তাঁর নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ এবং ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জিতেছে টিম ইন্ডিয়া। মুলতানে পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জেতার কৃতিত্ব রাহুলের। ওই ম্যাচে চোট পাওয়া সৌরভের অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দেন রাহুল। অধিনায়ক হিসাবে তাঁর প্রথম চারটি একদিনের সিরিজ জিতে নেন দ্রাবিড়।
আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, রাহুল দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভের সংঘাতে ভারতীয় ড্রেসিং রুম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে দলের অনেক সিনিয়ারই গুরু গ্রেগের আচরণ মেনে নিতে পারেননি।
অধিনায়ক দ্রাবিড় আইসিসি ট্রফিতে সাফল্য পাননি। ২০০৭ বিশ্বকাপে ব্যর্থতা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল দেশবাসীর কাছে। দলনেতা হিসেবে সেই দায়িত্ব রাহুল এড়াতে পারেন না। তবে অনেকেই মনে করেন, ভারতের ব্যর্থতার আসল কারণ গুরু গ্রেগের মানসিকতা। চার বছর আগের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের টিম স্পিরিটের ছিটেফোঁটা ছিল না ২০০৭-এর দলে।
দীর্ঘ ১৭ বছর পর সেই দুঃস্বপ্নকে দূরে সরিয়ে ফেলে শনিবার সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে গেলেন রাহুল দ্রাবিড়। আর এই সাফল্য এল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেরই এক দেশে। বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে শনিবার হার্দিক পান্ডিয়া সফলভাবে শেষ বলটা করার পর যেভাবে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন, এমনভাবে উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ কখনও দেখাননি দ্রাবিড়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, এমন একটা মুহূর্তের জন্য কত দীর্ঘ সময় ধরে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর শচীন বা সৌরভ কোচ হওয়ার কথা ভাবেননি। কিন্তু রাহুলকে দেখে বরাবরই মনে হয়েছে তিনি কোচ হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি। ২০১৮ সালে তাঁর কোচিংয়ে ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বোঝা গিয়েছিল, রাহুলের সিনিয়ার দলের দায়িত্ব নেওয়া সময়ের অপেক্ষা। রবি শাস্ত্রীর জায়গায় রাহুল জাতীয় দলের কোচ হওয়ার পর গত আড়াই বছরে সব ধরনের ক্রিকেটেই বেশ ভালো খেলেছে টিম ইন্ডিয়া। ’২২ সালে টি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছিল। গত বছর টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের ফাইনালে খেললেও সাফল্য আসেনি। টেস্ট সেরা হওয়ার ম্যাচে হারার পর সমালোচিত হন দ্রাবিড়। ঘরের মাঠে দ্বিতীয়বার বিশ্বসেরা হতে না পারাটা যন্ত্রণা দিয়েছিল তাঁকে। জানতেন এটাই শেষ সুযোগ। আর সেটা চমৎকার কাজে লাগালেন। একটি ম্যাচও না হেরে ট্রফি জেতা অসাধারণ কৃতিত্বের।
দেশের পাটা উইকেটে আইপিএল ম্যাচ খেলে আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিন্ন চরিত্রের পিচে মানিয়ে নিয়ে সফল হওয়া কম কৃতিত্বের নয়। রাহুল-রোহিতের বোঝাপড়াটা চমৎকার ছিল। পুরো প্রতিযোগিতায় ফোকাসড ছিল দল। চাপের মধ্যে পড়ে প্যানিক না করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। খেলোয়াড়রা নিজেদের দায়িত্ব সম্মিলিতভাবে পালন করে গিয়েছেন। আর রাহুল-রোহিত জুটি ক্রমাগত ব্যর্থ হওয়া কোহলিকেই ওপেনার রেখে দেওয়া বা অক্ষর প্যাটেলকে আগে ব্যাট করতে পাঠান কিংবা ঠিক সময় সঠিক বোলারকে আক্রমণে আনার মতো সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছেন। আর কোচের দায়িত্ব ছাড়ার আগে দ্রাবিড় টিম ইন্ডিয়া দলটিকে গড়ে দিয়ে গেলেন। ভারতীয় দলে অনেক প্রতিভার ভিড়। মাঝ তিরিশের রোহিত-বিরাট সরে দাঁড়ালেও টি২০ ক্রিকেটে ভারত সাফল্য ধরে রাখতে পারবে বলেই মনে হয়। আর টি২০ ক্রিকেটের ধকলটা নিতে হবে না বলে খানিকটা বিশ্রাম পাবেন রোহিত-বিরাট। আশা করব আরও এক-দু’বছর টেস্ট এবং একদিনের ক্রিকেটে দেশের হয়ে খেলবেন ওঁরা দুজন।
অধিনায়ক দ্রাবিড়ের চেয়ে কোচ দ্রাবিড়কে এগিয়ে রাখতে হবে। তবে ওই দুই ভূমিকার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল খেলোয়াড় রাহুল। ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট একাদশ বাছতে হলে তিন নম্বর ব্যাটসম্যানের জায়গাটা ওঁর জন্য রাখতেই হবে। যে কোনও পরিস্থিতিতে ‘দেওয়ালের’ মতো একপ্রান্ত আগলে রেখেছেন।
অনেক সময় অন্য প্রান্তের ব্যাটারের দাপটে যতটা বাহবা প্রাপ্য, ততটা পাননি রাহুল। ’৯৬-এর লর্ডস টেস্টের কথা ধরা যাক। অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন সৌরভ। ওটা রাহুলেরও অভিষেক টেস্ট ছিল। রাহুল ৯৫ রান করলেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেন সৌরভ। ’৯৯ বিশ্বকাপে সৌরভের ১৮৩ রানের পাশে খানিকটা ম্লান হয়ে থেকে যায় দ্রাবিড়ের সেঞ্চুরি। একইভাবে ইডেনে স্টিভ ওয়ার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুরন্ত জয়ের কান্ডারি ভিভিএস লক্ষ্মণ হলেও দ্রাবিড়ের সেঞ্চুরি ও সহযোগিতা ছাড়া ওই জয় আসত না।
তিনি যে স্বার্থক টিমম্যান সেই দৃষ্টান্ত খেলোয়াড় জীবনে একাধিকবার রেখেছেন রাহুল। দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটার হয়েও উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালনে রাজি হওয়ায় একদিনের ক্রিকেটে ভারতীয় দলের চেহারাটাই বদলে যায়।
২০০৯ সালে একদিনের দল থেকে বাদ পড়েন দ্রাবিড়। ভাবতে পারেননি আর কোনও দিন জাতীয় দলের হয়ে একদিনের ক্রিকেট খেলবেন।
তবু ডাক পেলেন ২০১১ ইংল্যান্ডে একদিনের সিরিজে। তারপরই জানিয়ে দেন দেশের হয়ে আর একদিনের ম্যাচ খেলবেন না।
শোনা যায়, ২০০৮ সালে সৌরভ যখন অবসর নিলেন, বোর্ডের প্রভাবশালী কিছু মানুষ নাকি চেয়েছিলেন এরপর দ্রাবিড়ও আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ইতি টানুন। রাজি হননি রাহুল। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আরও কিছুদিন অন্তত টেস্ট খেলার ক্ষমতা আছে। রাহুলকে টেস্ট দল থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। টেস্ট ক্রিকেটকে মাথা উঁচু করে বিদায় জানান ২০১২ সালে।
এবার ভারতের কোচের দায়িত্বও রাহুল দ্রাবিড় ছেড়ে দিলেন মাথা উঁচু করে। তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে জানি না। চাইব অন্তত জুনিয়ার স্তরে আগামীদিনের প্রতিভা তুলে আনার কাজে যুক্ত থাকুন। রাহুল দ্রাবিড়কে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রয়োজন আছে।
(লেখক সাংবাদিক)
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: উত্তরপ্রদেশের হাথরসে নারায়ণ সাকার ওরফে ‘ভোলেবাবা’ নামে এক স্বঘোষিত ধর্মগুরুর (Self-styled…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: উত্তরবঙ্গের উপরের পাঁচ জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস (Heavy…
সানি সরকার, শিলিগুড়ি: কয়েকদিন ধরে প্রবল বৃষ্টি (Heavy Rain)। তার জেরে তিস্তায় জলস্ফীতি (Teesta River…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: উত্তরপ্রদেশের হাথরসে পদপিষ্ট (Hathras Stampede) হয়ে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১১৬ জনের।…
গঙ্গারামপুরঃ শহরে বিভিন্ন নামী রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান কিংবা বেনামি খাবারের দোকানে বিশেষ অভিযান চালিয়ে চক্ষুচড়কগাছ…
নাগরাকাটাঃ ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী কে নিয়ে সহায় সম্বলহীনদের সঙ্গে নিজের ৪০ তম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করলেন…
This website uses cookies.