উত্তর সম্পাদকীয়

হ্যাঁ-মোদি বনাম না-মোদি’র ভোট

  • শুভাশিস মৈত্র

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। এই অষ্টাদশ লোকসভা ভোটের ফল কী হবে তা কার্যত আগাম ঘোষণা করে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বারবার বলেছেন, বিজেপি ৩৭০ আসন পার করবে আর বিজেপির জোট এনডিএ, যার সদস্য সংখ্যা এখন চল্লিশের কাছাকাছি, তাদের সম্মিলিত আসন সংখ্যা হবে ৪০০ বা তার থেকেও বেশি। এইভাবে আসন সংখ্যা আগাম ঘোষণা করে অতীতে কখনও ভোট হয়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০২৪-এর ভারতের লোকসভা ভোটকে অনেকটা সেরকমভাবে ভোটারদের সামনে উপস্থিত করেছেন। দল হিসেবে বিজেপি প্রায় আড়ালে চলে গিয়ে, এবারের ভোট হয়ে উঠেছে মোদি বনাম ইন্ডিয়া জোটের (যতটুকু টিকে আছে) ভোট। আরও স্পষ্ট করে বললে এই ভোট এখন, হ্যাঁ-মোদি বনাম না-মোদি’র ভোট।

সংসদে এবং সংসদের বাইরেও মোদি বেশ কয়েকবার বলেছেন, ঈশ্বর তাঁকে দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি এখন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। কেউ কেউ তাঁকে রামের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। মোদি বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন, এতদিন যা কিছু দেখা গিয়েছে, সব হল ট্রেলার। আসল ছবি এখনও বাকি রয়েছে। অন্তত তিনজন বিশিষ্ট বিজেপি নেতা বলেছেন এনডিএ’র ৪০০ আসন দরকার, কারণ সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। অবশ্য বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এই বিবৃতিকে সমর্থন করেনি। তবে এটাও ঠিক, আমরা যদি আরএসএসের অন্যতম নেতা, যিনি ‘গুরুজি’ হিসেবেই বেশি পরিচিত, সেই মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকারের বক্তৃতার সংকলন ‘বাঞ্চ অফ থটস’ পড়ি, তাহলে দেখব, ভারতের সংবিধান সম্পর্কে বহু অবমাননাকর বাক্য সেখানে রয়েছে। ফলে তাঁর উত্তরসূরিদের মুখে সংবিধান পরিবর্তনের ভাবনা মোটেই তাঁদের আদর্শের সঙ্গে বেমানান নয়।

বিজেপি এবং এনডিএ কি মোদির ঘোষিত দুটি আসনসংখ্যা ছুঁতে পারবে? কোথা থেকে আসবে বাড়তি আসন? কংগ্রেসের আসন এখনই যথেষ্ট তলানিতে, তাকে আরও কমানো কঠিন।  ফলে বাড়তি আসনের জন্য বিজেপি চাইছে কয়েকটি আঞ্চলিক দলকে পর্যুদস্ত করতে। স্বাধীনতার পর ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা ভোটে কংগ্রেস, বাম এবং জনসংঘ বাদেও বেশ কয়েকটি দল ছিল। সেইসব দল ক্ষমতায় ছোট ছিল, কিন্তু আদর্শের দিক থেকে তারা ছিল জাতীয় দল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল জন্ম নেয়।

এইসব দলের জন্মের পিছনে যুক্তি এবং বাস্তব কারণ ছিল। যেমন বলা যায় তামিলনাডুর ডিএমকে না থাকলে ১৯৬৫ সালেই হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হয়ে যেত। ডিএমকের প্রবল আন্দোলনের চাপেই লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে সেদিন রেডিওতে ক্ষমা চেয়ে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল হিন্দি-সিদ্ধান্ত। এই মুহূর্তে দেশের সবক’টি রাজ্য মিলিয়ে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ১৪৫৫, কংগ্রেসের, ৬৮৪ আর সিপিএম, আপ সহ আঞ্চলিক দলগুলির হাতে রয়েছে ১৮৯৩ জন বিধায়ক। এর থেকেই বোঝা যায় আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি পরিবারকেন্দ্রিক আঞ্চলিক দল তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করেছে। যদিও এমকে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে তামিলনাডুর ডিএমকে সেই তালিকায় পড়ে না, তবে এআইএডিএমকে দুর্বল হয়ে পড়ায় বিজেপি সেই শূন্যস্থান পূরণ করে দক্ষিণের এই রাজ্যটি থেকে আসন বাড়াতে সক্রিয় হয়েছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম দুর্বল হয়ে পড়ায় তারা দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে নিয়েছে। তবে বাংলায় ২০১৯-এ আসন সংখ্যায় বিজেপি যতটা সফল হয়েছে, তামিলনাডুতে ২০২৪-এ আসন সংখ্যায় সেই সাফল্য আসবে বলে মনে হয় না।

বিজেপিকে ৩৭০ আসন পেতে হলে কী করতে হবে, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। কাজটা কত কঠিন তা বোঝার জন্য মনে রাখতে হবে, গত ১৭টি লোকসভা ভোটে বিজেপি কখনোই সাড়ে তিনশো বা তার কাছাকাছি আসনও পায়নি। এনডিএ জোট গড়ে ২০১৪-তে বিজেপির আসন ছিল ২৮২, ২০১৯-এ সেটা বেড়ে হয় ৩০৩। অন্যদিকে ১৯৫২ থেকে ১৯৮৪, এই সময়ে যে ৮ বার লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস মোট ৬ বার ৩৫০-র বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর আর কখনও কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ৩৫০ ছুঁতে পারেনি। ৩৫০ তো দূরের কথা, কংগ্রেস ১৯৮৪-র পর ২০০ আসন ছাড়িয়েছে মাত্র দু’বার, ১৯৯১ এবং ২০০৯। ফলে কোনও সন্দেহ নেই, মোদির তৃতীয় দফায় এসে বিজেপির ৩৭০ আসন দখল করা যথেষ্ট কঠিন কাজ।

মহারাষ্ট্র, গোয়া, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, পঞ্জাব, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, চণ্ডীগড়, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, এই ১৫টি রাজ্যের ৩১৫টি আসন। এর মধ্যে ২০১৯-এ এনডিএ পেয়েছিল ২৮৩টি। অর্থাৎ এনডিএ মোট আসনের ৮৯.৮ শতাংশ আসন জিতে নিয়েছিল ১৫টি রাজ্য থেকে। এই ১৫টি রাজ্য থেকে এনডিএ বা বিজেপি প্রার্থীদের আর একটিও আসন বাড়ানো খুবই কঠিন কাজ। কারণ এখানে প্রায় ৯০ শতাংশ আসন তারা ইতিমধ্যেই জিতে বসে আছে। খুব সম্ভাবনা আছে এখানে কিছু আসন কমে যাওয়ার। কারণ ২০১৯-এ যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও পরবর্তী জাতীয়তাবাদের হাওয়া তৈরি হয়েছিল, তেমন কোনও হাওয়া এই লেখার সময় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া বিহার এবং মহারাষ্ট্রের (মোট আসন ৮৮) পরিস্থিতিও অনেকটা বদলে গিয়েছে গত পাঁচ বছরে।

তাহলে বিজেপিকে আসন বাড়াতে হবে দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতেও বিজেপি যথেষ্ট আসন পেয়ে বসে আছে। খুব বেশি কিছু ওইসব রাজ্য থেকে হবে বলে মনে হয় না। রইল দক্ষিণ ভারত। কংগ্রেসের সরকারে থাকায় কর্ণাটকে ২০১৯-এর মতো ২৮-এ ২৫টি আসন বিজেপি এবার সম্ভবত পাবে না, বেশ কিছু আসন কমে যেতে পারে এই রাজ্যে।

তামিলনাডু (৩৯), কর্ণাটক (২৮), অন্ধ্রপ্রদেশ (২৫), কেরল (২০), তেলাঙ্গানা (১৭), এবং পুদুচেরি (১), সব মিলিয়ে দক্ষিণ ভারতের এই যে ১৩০টি আসন, তার মধ্যে বিজেপি ২০১৯-এ ২৯টি আসন পেয়েছিল। বাকি ৮৫ আসনে পরাজিত হয়েছিলেন বিজেপি বা এনডিএ প্রার্থীরা। বিজেপি চাইছে তামিলনাডু থেকে ২০টি আসন এবং দক্ষিণের অন্য রাজ্যগুলি থেকে আরও কিছু আসন তুলে আনতে। ২০টি আসন তামিলনাডুতে হওয়া প্রায় অসম্ভব। সংখ্যাটা দশের নীচে থাকবে বলেই নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বিজেপির ৩৭০ বা এনডিএ’র ৪০০ প্রায় অসম্ভব একটি লক্ষ্য বলে মনে হয়।

জওহরলালের নেতৃত্বে কংগ্রেসের আসনও ১৯৬২-তে তৃতীয় দফায় এসে হয়েছিল ৩৬১। ১০টি আসন কমে গিয়েছিল ১৯৫৭-র থেকে। তৃতীয় দফায় এসে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি যদি সত্যিই লক্ষ্যপূরণে সফল হয়, তা হবে একটা অতি ব্যতিক্রমী ঘটনা। প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপির আসন ২০১৯-এর ৩০৩-এর থেকেও কমে যাওয়ার। কতটা কমবে তা অবশ্য ৪ জুনের আগে বলা সম্ভব নয়।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

যে শালিক মরে যায় কুয়াশায়, সে তো আর…

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য সকালে এক শালিক দেখা মানেই বুক দুরুদুরু! এই রে দিনটা খারাপ হতে চলেছে!…

16 mins ago

আবেগের ভক্তিরস বনাম দারিদ্র্য

রূপায়ণ ভট্টাচার্য মন্দিরের মতো দেখতে রাজকীয় অযোধ্যা রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে একটি কাঠবেড়ালির…

26 mins ago

Supreme court | উপাচার্য নিয়োগে রাজনীতি বরদাস্ত নয়, বোসকে কড়া বার্তা সুপ্রিম কোর্টের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত নয়। স্পষ্ট জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।…

43 mins ago

Gang rape case | চলন্ত ট্রেনে গণধর্ষণের শিকার মডেল! প্রায় ২ মাস পর অভিযোগ দায়ের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চলন্ত ট্রেনে নেশার জিনিস খাইয়ে এক মডেলকে গণধর্ষণের (Gang rape case)…

47 mins ago

Hardik Pandya Banned | মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে দুঃসংবাদ! পরের আইপিএলে দলের প্রথম ম্যাচে নির্বাসিত হার্দিক

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: একে তো ঘরের মাঠে লখনউ সুপার জায়ান্টসের (Lucknow Super Giants) কাছে…

2 hours ago

Bus Accident | চাকুলিয়ায় বাস দুর্ঘটনায় মৃত ২, আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩

কানকি: মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় (Bus Accident) মৃত্যু হল ২ জনের। আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩…

2 hours ago

This website uses cookies.