- শ্যামলী সেনগুপ্ত
‘ফিরে যাবো বলে খুঁজি চাবি/নতুন বাড়ির পথ/ফিরে যাবো বলে খুঁজি/দেশলাই জ্বেলে খুঁজি…’
ফিরেই তো গেলেন। ফিরে গেলেন রূপান্তরের পথে। হয়তো এ যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনও এক হা-ক্লান্ত অপরাহ্ণে। ঠিক ওরকম সময়েই তো সুনন্দা স্নানটান সেরে পরিপাটি হয়ে বসতেন কবিতার আসনে।
তিনি কবি সুনন্দা চক্রবর্তী। আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে শূন্য দশকের প্রথম পর্বে শিলিগুড়ির কাব্য-সমাজের এক ভিন্ন স্বর, বলিষ্ঠ উচ্চারণ সুনন্দা। জন্ম ১৯৩৭, ময়মনসিংহে। তবে এই উত্তরের ভূমিতে তাঁর বিচরণ শৈশব থেকেই। বাবা ছিলেন ডাক্তার। ডুয়ার্সের তাসাটি চা বাগানের স্বনামধন্য ডাক্তার বিভূতিভূষণ মৈত্রের বড় মেয়ে সুনন্দা। পেশায় শিক্ষক সুনন্দার গার্হস্থ্য যাপন অসমের দুলিয়াজানে।
তাঁর প্রয়াণের খবরে মনে পড়ল ২০০৩ সালের কথা। এই শিলিগুড়ির কলেজপাড়ার এক কবিতার আসরের কথা। সেই সময় কবি-লেখক ও সংস্কৃতি জগতের খুব কাছের মানুষ ছিলেন হরেন ঘোষ। তিনি আয়োজন করেছিলেন সেই কবিতার আসর। পিতৃতুল্য মানুষটির আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে শুনি সুনন্দার বলিষ্ঠ উচ্চারণ। সেই অমোঘ পংক্তি, ‘আমার একটি ফলসা গাছ চাই’।
ওই স্বর, ওই উচ্চারণ আর ওই ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আসর শেষে আলাপ হল, বন্ধুত্ব হল। প্রতিমাসের দ্বিতীয় শনিবারে হকার্স কর্নারের গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের ঘরে কবিতার আসরে দেখা হত সুনন্দার সঙ্গে। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা সকলে অপেক্ষা করে থাকতাম, এই কবি কী পড়বেন, তার জন্য।
কী অসাধারণ উচ্চারণে প্রতিটি শব্দ ছড়িয়ে দিতেন কাব্যমহলে! কবিতায় নিমগ্ন, কবিতার কাছে সমর্পিত এই মানুষটি কি একটু উদাসীন ছিলেন। গুছিয়ে নিতে শেখেননি হয়তো। তখন তাঁর মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘প্রযত্নে সময়’ এবং ‘রূপ রূপান্তর’।
পরে অনবদ্য একটি কবিতার বই হয়, ‘আড় থেকে বলো’। এই বই প্রকাশের দিন আমরা অনেকে ছিলাম। স্বকণ্ঠে পাঠ করেছিলেন,‘আড় থেকে বলো/দিগন্ত-বিস্তার থেকে বলো/নাবাল পাটের ক্ষেত/পা পেতে বসে আছে…’।
প্রিয়জন হারানোর শোক তাঁর ভেতরের সত্তাকে ধীরে ধীরে খেয়েছে। কিন্তু কবিতার কাছেই সমর্পিত ছিলেন তিনি। সুনন্দার বাড়িতে গিয়ে দেখেছি, নার্সারি যেন। গাছপালা ছড়িয়ে গিয়েছে একটু ভেতরে। পাশে একটি বাঁশ ঝাড়। একটু নিরালা, সকলের মাঝে থেকেও একটু একা একা বাড়ির ভেতরে থাকতেন এক রাজেন্দ্রাণী।
কাব্যিক মেজাজ তেমনটাই ছিল। আর ছিল একপাল কুকুর ও বিড়াল। সকলেই বন্ধু। তাঁর কবিতার লাইন যেন এসব নির্দিষ্ট করে দেয়। ‘কবিতায় সিক্ত বাঁশ ঝাড়/সন্ধ্যা নামে জোনাকি মালায়/যখন অন্ধকার ঝিঁঝি গাঢ় বেণুবন।’
শেষের দিকে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আরও একাকিত্বের দিকে তাঁর যাত্রা। মা আর মেয়ে। মেয়ে এবং মা।
বাংলা ছেড়ে দিন, উত্তরবঙ্গে তেমনভাবে সম্মাননা পেলেন কই! তাঁর কবিতার মতো কবিতা আর পাই না। তবু কবিকে সংবর্ধনা দিয়ে বা পুরস্কারে মুড়ে বেঁধে রাখা যায় না। কবি চলেন আপন খেয়ালে। সুনন্দার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘বাংলা কবিতা উৎসব’ প্রাঙ্গণে, কখনও শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পারিবারিক ঘেরাটোপে, হিলকার্ট রোডে। মানুষ একা আসে, একাই ফিরে যায়। মনে পড়ে স্মৃতিমাখা কিছু লাইন।
‘পথ দুরূহ/নেই প্রত্যুগমন;/ তবু আসছো তো,/ যে ভাবে জন্ম আসে/ আসে মৃত্যু অবধারিত।’
(লেখক সাহিত্যিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)