বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

হাওয়া এসে বলে যায়, হম সব অচ্ছে হ্যায়

শেষ আপডেট:

 

  • সুকান্ত নাহা

‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।’ বহুশ্রুত এই কবিতার পংক্তিটি কি শুধুমাত্র একটি আবেগ থরথর উচ্চারণ হয়েই রয়ে যাবে?  ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…’ কি কোনও অনুভব নয়, নিছকই একটি জনপ্রিয় গানের লাইন?  অথবা ক্যানভাসে জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে ভ্যানগগের সেই উপলব্ধি ‘man is not on the earth solely for his own happiness. He is there to realise the great things for humanity.’ কি নিছকই একটি তাৎক্ষণিক অনুভব?

এরকম মনুষ্যত্ব জাগানিয়া আরও কত কবিতা, গান ও অনুভবের কথা সারা বিশ্বজুড়ে মানবতাবাদী মানুষজন রেখে গিয়েছেন। কিন্তু সেই ‘আদিম হিংস্র মানবিকতা’-র পরিমার্জিত সংস্করণ এই নেটালোকিত বিশ্বেও চরমভাবে প্রতীয়মান। বর্তমানে মানুষ মানুষকে মেরে, ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে নিজে সুখে থাকবে, এটাই যেন স্বতঃসিদ্ধ।

তাহলে আজকের দুনিয়ায় বিশ্বের সর্বত্র দুর্বল, পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে কি কেউ থাকবে না? ন্যায্য প্রাপ্যটুকুর জন্য যারা সোচ্চার হতে পারে না, যাদের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর কারও কানে পৌঁছায় না অথবা পৌঁছালেও তা উপেক্ষিত রয়ে যায়, তাদের জন্য কি কেউ কথা কইবে না? ‘মানুষ হয়ে’ পাশে দাঁড়ানোর কর্তব্য তবে কার? রাষ্ট্রের? রাষ্ট্রক্ষমতার হোলি-ব্যাটন যাদের হাতে তাদের? নাকি আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষ যারা, তাদের। সহজ উত্তর হল – সকলের প্রকৃত বাস্তবে সাধারণ মানুষ এখন  ‘আপনি বাঁচলে…’-র দলে।

এটাই সত্য। পাশের মানুষটি কেমন আছে কেউ জানতে চায় না। রইল গিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা। দরিদ্র, দুর্বল মানুষের পাশে রাষ্ট্র নেই, এটি বলা সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছু নয়। উক্ত শ্রেণির মানুষের কল্যাণার্থে এদেশে সরকারের বহু উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু সেসব অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাছে পৌঁছায় না। সেক্ষেত্রে সেইসব কল্যাণকারী প্রকল্পের সুফল ন্যায্য প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে তাদের চরম ব্যর্থতা, উদাসীনতাই কি এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে দায়ী নয়?

তা না হলে বছর সত্তরের নয়নী সরকার (নাম পরিবর্তিত) সংলগ্ন অম্বিকানগর জোড়াপানি নদীচরের বানভাসি বৃদ্ধা পেটের দায়ে দোরে দোরে ভিক্ষা করবেন কেন? কোভিড যার পুত্র-পুত্রবধূকে কেড়ে নিয়েছে। ঘরে পাঁচ ও চার বছরের নাবালক দুই নাতি, যার একটি অন্ধ। আছে আট বছরের একটি নাতনি। র‌্যাশন কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার আইডি ভেসে গিয়েছে গেল বন্যায়। বৃদ্ধা পেনশনও তাই অধরা। চরের বুকে ত্রিপলঘেরা ঘর অবশ্য একটি আছে। আগামী বর্ষায় সেটিও থাকবে কি না কে জানে।

প্রশ্ন করেছিলাম, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাউকে জানাননি?’
উত্তর এল, ‘অনেকরে কইসি রে বাবা, কেউ শোনে না এই বুড়ির কথা।’ বুড়ি আঁচলে চোখ মোছে। হাওয়া এসে কানে ফিশফিশ করে বলে যায়, ‘বুড়ি ভীষণ ‘মিথ্যেবাদী’। হম সব অচ্ছে হ্যায়।’

(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। নাগরাকাটায় কর্মরত)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝেছিলেন, নরেন নররূপী নারায়ণ

শংকর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁর জন্মতিথি পালন করা হলেও ইংরেজি তারিখটিকেও...

নগরজীবনে বিষণ্ণতার প্রান্তরে একাকিত্ব

  রুদ্র সান্যাল শহরজীবন যত আধুনিক হচ্ছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান...

লালনকে মুছলে আরও বিপন্ন বাংলাদেশ

  অংশুমান কর অশান্ত বাংলাদেশে মৌলবাদ যে ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে...

বুদ্ধি, বুদ্ধিজীবী এবং ঘৃণার এক সাম্রাজ্য

মৃড়নাথ চক্রবর্তী আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে দাঁড়িয়েও বাংলায় ‘বুদ্ধিজীবী’...