Sunday, February 16, 2025
Homeসম্পাদকীয়উত্তর সম্পাদকীয়ইউএপিএ : লঙ্কায় গেলেই হতে হয় রাবণ

ইউএপিএ : লঙ্কায় গেলেই হতে হয় রাবণ

 

  • অর্ক দেব

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব ফুরিয়ে আসছে। নির্বাচনি নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, নবমীর নিশি অপস্রিয়মাণ। আর এই শেষবেলায় সকলের মনে প্রশ্ন একটাই। ক্ষমতা কে কুক্ষিগত করবে? ক্ষমতার অলিন্দে যাঁর অবাধ পদচারণা ছিল মানুষ কি তাঁকে টেনে নামাবে? নতুন কাউকে বেছে নেবে? নাকি মসনদে অবিচল থাকবেন পুরোনো শাসক? সাংবাদিকদেরও ছোটাছুটি শেষ। এবার নিজের রাজ্যের এ তল্লাট থেকে ও তল্লাট ঘুরে, ভিনরাজ্যে পড়ি কি মরি ঘুরে চটির সুকতলা খুইয়ে ক্লান্ত দেহমনে বাড়ি ফিরে আসবেন নবীন-প্রবীণ।

আর এই এখনই যদি প্রশ্নটা রাখা যায়, ভোটের যারা প্রধান কুশীলব, সেই নেতারা কি সবার কথা বললেন? সংবাদমাধ্যম কি সকলের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারল? আমাকে দেখুন, আমাকে ক্ষমতা দিন, এই আপ্তবাক্য পেরিয়ে যে সবচেয়ে অক্ষম তার পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার কি কেউ করতে পারল?

নিউজক্লিক সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থর মুক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছে, কেউ কথা রাখেনি৷ দেশের অন্যতম কালাকানুন আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট বা ইউএপিএ-র অপব্যবহার রুখে দেওয়ার কথা চিৎকার করে বলেনি কেউ, জেলের ভিতর বিনা বিচারে যারা পচছে তাদের নাম মুখে আনেনি কোনও পক্ষ। ফলে ক্ষমতার মাহাত্ম্য যাঁদের খাঁচাবন্দি করে রেখেছে, তাঁরা জানেন, সুপ্রিম কোর্টই এক এবং একমাত্র ভরসা, ন্যায়ালয় চোখ তুলে চাইলে বিচার হবে, না হলে অপেক্ষা অনন্ত।

অপেক্ষার পাহাড়প্রমাণ ভার যিনি জেলের ভিতরে রয়েছেন শুধু তাঁরই নয়, তাঁর যে আত্মীয়রা ছুটে মরছেন, এর ওর দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরছেন তাঁদেরও। দুজনেরই অবশ্য দিনশেষে শূন্যচোখে পথ চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। ২০২১ সালের নভেম্বরে, এলাহাবাদ হাইকোর্ট শারজিল ইমামকে জামিন দেওয়ার সময়ে বলে, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে চত্বরে (এএমইউ)  বক্তৃতার সময় শারজিল কাউকে অস্ত্র তোলার আমন্ত্রণ জানাননি। হিংসা ছড়ানোর লক্ষ্যে তিনি জমায়েতের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেননি। এই দৃঢ়, স্পষ্ট রায় সামনে আসার পরেও শারজিল জেল হেপাজতেই দিন কাটাচ্ছেন ইউএপিএ-র সৌজন্যে।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে সাজার মেয়াদ তিন বছর। সাড়ে চার বছর জেলে কাটানো হয়ে গিয়েছে তাঁর। আজ পর্যন্ত একটি অভিযোগেও শাস্তি হয়নি, মামলার নিষ্পত্তিও হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু ইউএপিএ দিয়েছে তাই তামাম রাষ্ট্রবাসীর চোখে তিনি জঙ্গি। অনেকটা অচ্ছুত, সামাজিকভাবে নির্বাসিত। জেলের ভিতরেই দু’বার করোনা হয়ে গিয়েছে শারজিলের। ছাড়া পেয়েছেন অনেক দাগি আসামি, শারজিলের ছুটির দিন আর আসে না।

একই অবস্থা উমর খালিদের। সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির হিংসায় মৃত্যু হয় ৫৩ জনের। ঘটনার অন্যতম মূল ষড়যন্ত্রকারী বলে দাবি করে উমরকে উসকানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশ। যথারীতি ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রদ্রোহী বলে রাতারাতি দাগিয়ে দেয় মিডিয়ারই একাংশ। সম্প্রতি ইউএপিএ মামলায় সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আর্জিই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন উমর খালিদ।

প্রশ্ন হল, যদি সত্যি উমর বা শারজিল জঙ্গি হন, রাষ্ট্রদ্রোহ করে থাকেন তবে কেন রাষ্ট্র তড়িঘড়ি সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করছে না? কেন ‘তারিখ পে তারিখ’? আর উমররা যদি নির্দোষ হন, তাহলে তাঁর জীবনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিনগুলি নষ্ট করার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

উমরের সঙ্গী বনজ্যোৎস্না লাহিড়ি বলেন, ‘ইউএপিএ দিয়ে গ্রেপ্তার করার অর্থ আপনার মাথায় লিখে দেওয়া হল আপনি জঙ্গি। নানা সময়ে ইউএপিএ দিয়ে যাদের আটকে রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে শাস্তি পেয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু বাকিরা, যারা নির্দোষ, তারাও অনেকে দশ বছর বা তার বেশি সময় নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। এক্ষেত্রে এই দীর্ঘসূত্রিতাই শাস্তি।’

শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাবে উমর খালিদের শ্লেষ, ‘মাই নেম ইজ উমর খালিদ অ্যান্ড আই অ্যাম নট এ টেররিস্ট।’ কিছুতেই ভোলা যায় না ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়েছিল জেসুইট ফাদার স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে। শেষ দিনগুলিতে জল খাওয়ার জন্য স্ট্র চেয়ে পাননি পার্কিনসনে আক্রান্ত এই বৃদ্ধ।

কালাকানুন কিন্তু ব্রিটিশ আমলেও ছিল। ১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ  রাওলাট আইন প্রণয়ন হয়।  এই আইনে সরকার বিরোধী যে কোনও প্রচারকেই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়। এবং আইনবলে কোনওরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই যে কোনও সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় ও বিনা বিচারে গ্রেপ্তার করার ছাড়পত্র দেয় এই আইন। আরও বলা হয়, যতদিন খুশি আটক রাখার অবাধ ক্ষমতা ও ঘরবাড়ি তল্লাশির অধিকার সরকারের আছে। সেদিনের রাওলাট আইন আর আজকের ইউএপিএ-র ফারাকটা কোথায়? রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গোটা দেশে আগুন জ্বলে যায়। বিনা বিচারে বিরামহীন বন্দিত্ব মানুষ কিছুতেই মেনে নেয়নি। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছিল রাওলাট আইনের বিরুদ্ধেই।

মদনমোহন মালব্য, মহম্মদ আলি জিন্নাহ-রা  আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন। নরমপন্থী-চরমপন্থীরা একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। গোটা দেশ মহাত্মা গান্ধির মতো একজন নেতা পায় রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনের সূত্রেই। দেশের আনাচকানাচে চোরাগোপ্তাভাবে, স্থানীয় স্তরে দমনমূলক আইন জারি রাখতে সক্ষম হলেও ব্রিটিশ সরকার কিন্তু রাওলাট আইন দেশজুড়ে বলবৎ করতে পারেনি। সেদিন প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সংবাদমাধ্যম।

ইতিহাসের এমন বিচিত্র লীলা, এই আইন প্রয়োগের প্রতিবাদের ঠিক একশো বছর পরে সংখ্যার জোরে সংসদের দুই কক্ষেই ইউএপিএ-তে সংশোধনী পাশ করায় এনডিএ। যে সংশোধনীতে বলা হচ্ছে, শুধু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন নয়, যে কোনও ব্যক্তিকেই সন্ত্রাসী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা যাবে। পাশাপাশি আরও বলা হয়, আগামীদিনে যে কোনও রাজ্যের বাসিন্দার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার থাকবে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশের অনুমতিও লাগবে না এনআইএ-র। অভিযুক্তকে নিজেকেই নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে বিশেষ আদালতে।

এতৎসত্ত্বেও মহুয়া মৈত্রর মতো ব্যতিক্রমী দু’একজন ছাড়া কোনও রাজনৈতিক দলই সোচ্চারে ইউএপিএ-র বিরোধিতা করেনি। তিলমাত্র নাগরিক সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। বরং যাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ হয়েছে তাঁকে যাতে সমাজের চোখে হীন প্রতিপন্ন করা যায় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা জারি রেখেছে একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম। অরবিন্দ কেজরিওয়াল তো প্রকাশ্যেই উমর খালিদের গ্রেপ্তারি সমর্থন করেছেন। নিজেকে সাচ্চা হিন্দু প্রমাণ করার দায় আছে যে!

বর্তমান শাসক না হয় এই আইনকে সবচেয়ে নৃশংসভাবে প্রয়োগ করেছে। কেন এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ করে না বিরোধীরা? ভুললে চলবে না, ইউপিএ আমলেই অপারেশন গ্রিন হান্টের জন্ম। কোন অপরাধে জিএন সাইবাবাকে ইউএপিএ প্রয়োগ করে দশ বছর জেল খাটানো হল, কে দেবে তাঁর দুর্ভোগের মূল্য, এ সব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ ভোটবাক্সে কোনও প্রভাব ফেলবে না, বরং দেশের একটা বড় অংশ নরেন্দ্র মোদির লবজ ধার করে অ্যান্টি ন্যাশনাল দাগিয়ে দিতে পারে, তাই চুপ নেতারা।

এ কথা ঠিক, সিপিএম-এর নির্বাচনি প্রচারপত্রে ইউএপিএ বাতিলের কথা ফলাও করে বলা হয়েছে। কিন্তু তথ্য বলছে, কেরলে ২০১৬-২০২১’এর মধ্যে অন্তত ১৪৫ জনের ক্ষেত্রে এই মামলা ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে, প্রচারপত্রের আশ্বাস কি বিশ্বাসযোগ্য? আসল সত্য হল, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। শারজিলের মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকা কবে শেষ হবে, এ প্রশ্নে আত্মমগ্ন রাজনীতিবিদদের কিস্যু এসে যায় না।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img
[td_block_21 custom_title="LATEST POSTS"]

Most Popular