প্রতীকী ছবি
‘শোলে’ ছবির সেই আইকনিক চেজ সিকোয়েন্সটা মনে পড়ে? যে দৃশ্যের প্রশংসা এমনকি স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত করেছিলেন। ‘শোলে’ ছবির ওই দৃশ্যে সঞ্জীবকুমার, ধর্মেন্দ্র এবং অমিতাভ বচ্চন একটা মালগাড়িতে করেই যাচ্ছিলেন। কিংবা আধুনিক সময়ের রোমান্টিক প্রেমগাথা ‘যব উই মেট’-এ সেই ট্রেনে আদিত্য এবং ঘরপালানো গীতের দেখা হওয়ার কথা ভাবি। ইমতিয়াজ আলির প্রেমগাথায় করিনা কাপুর আর শাহিদ কাপুরের কেমিস্ট্রির ঝলক আমরা দেখতে পেয়েছিলাম প্রথম এক রেল কামরাতেই। আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ করলাম, ২০০৭-এর ‘যব উই মেট’-এর পর বলিউডের হিট সিনেমায় আর ট্রেন তেমন চরিত্র হিসেবে আসেনি! ‘পপুলার কালচার’ যেহেতু সবসময় সময়ের নিক্তিতে কে উপরে উঠছে এবং কে নীচে নামছে, সেটা জেনে নিয়েই সংযোগস্থাপন করে, তাহলে কি ধরে নিতে হবে ভারতবর্ষে ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে রেল আর আকর্ষণীয় ‘ব্যাকড্রপ’ বা ‘প্রেক্ষাপট’ নয়!
বলিউড বা ‘পপুলার কালচার’ থেকে ভারতীয় রেলের সরে যাওয়া আসলে কি সেই ব্যঞ্জনাটাকে পরিস্ফুট করে যে, আজকের সময়ে ‘রেল চলে ঝমাঝম’ নয়, বরং ‘পা পিছলে আলুর দম’ই বেশি সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে! এক বছরের ব্যবধানে, ২০২৩-এর জুনে বালাসোরে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা এবং এই জুনে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ঘটনা আসলেই তো রেলকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। ভারতবর্ষে বিমানযাত্রীর সংখ্যা যতই বাড়ুক কিংবা নরেন্দ্র মোদির সরকার যতই ‘বন্দে ভারত’ নিয়ে উল্লসিত হোক, এদেশের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে আমজনতা মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ এখনও সাধারণ ট্রেনের উপরেই নির্ভর করেন। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের জন্য এখনও ট্রেনই প্রধান ভরসা। এটা সত্যি, গত সিকি শতাব্দীতে হয়তো উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় আসা ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু উলটোটাও সত্যি, অর্থাৎ যাত্রীসংখ্যা বাড়ায় এখনও উত্তরবঙ্গের জন্য ট্রেন সংখ্যা অপ্রতুল। আর সেই কারণেই যাঁরা ‘বন্দে ভারত’ চড়তে পারবেন না, তাঁদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, সেই দুশ্চিন্তা তো হবেই।
দক্ষিণ ভারতের ট্রেন বিশেষজ্ঞ টিএস অরুণ দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পর তাঁর নিবন্ধে নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং সেই সরকারের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোকে তুলোধোনা করেছেন। অরুণের যুক্তি খুব পরিষ্কার। অন্য অনেকের মতো তিনিও বলছেন যে, বর্তমান সরকার রেলে ঠাটবাট এবং গ্ল্যামার বাড়াতে গিয়ে সাধারণ ট্রেনগুলিকে উপেক্ষা করেছে এবং যাত্রীদের নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের এই অভিযোগ কতটা সত্যি তা সিএজি রিপোর্টে চোখ বোলালেই পরিষ্কার। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকারই শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ঘোষণা করেছিল যে, প্রতি বছর ভারতীয় রেলের ৪৫০০ কিলোমিটার ট্র্যাক আধুনিকীকরণ করা হবে। কিন্তু সিএজি রিপোর্ট বলছে, ওই শ্বেতপত্র প্রকাশের পরের ৭ বছরে তেমন কিছুই হয়নি। রেলের নিজস্ব রিপোর্ট অনুযায়ী ওই সময়ের মধ্যে রেলপথের আধুনিকীকরণের জন্য ৫৮,৪৫৯ কোটি টাকা খরচের কথা ছিল। কিন্তু খরচ হয়েছিল মাত্রই ৬৭২ কোটি টাকা।
তাহলে আসলে রেলের সত্যিকারের আধুনিকীকরণ বা যাত্রীসুরক্ষার জন্য সরকার গত ১০ বছরে কতটা কাজ করেছে? প্রতিবারই যে কোনও রেল দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশ্ন ওঠে দুটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু ছিল কি ছিল না? প্রতি কিলোমিটারে ‘কবচ’ চালু করতে আনুমানিক ৫০ লক্ষ টাকা দরকার। দেশে ৮ লক্ষ ২৬ হাজার কিলোমিটার রেলপথকে ‘কবচ’ দিয়ে বিপন্মুক্ত করতে গেলে আনুমানিক ৬৩,০০০ কোটি টাকা দরকার। ২০১৭ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকারই রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষণ কোষ তৈরি করেছিল, যা বলেছিল বছরে ২০,০০০ কোটি টাকা রেলের আধুনিকীকরণের জন্য খরচ করবে। কিন্তু সিএজি রিপোর্ট ২০২২-এ আঙুল তুলে বলেছিল ওই টাকা রেল খরচ করেছে শীতবস্ত্র কিনতে, আসবাবপত্র বানাতে কিংবা ভালো থালা-বাটি-গ্লাস কিনতে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব না যে, গত দশ বছরে রেলের জন্য লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন বা পাউডার যথেষ্ট জোগাড় করা হয়েছে, কিন্তু যাকে এসব মাখানো হচ্ছে, তার স্বাস্থ্য কীরকম সেইদিকে সরকার নজর দেয়নি!
বর্তমান সরকার ক্রমাগত স্লিপার কোচ বা অশীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরা কমিয়ে এসি কোচ বাড়িয়েছে। বিরোধীরা তো বটেই, বিশেষজ্ঞদেরও প্রশ্ন, এসি কোচের জমক দেখাতে গিয়ে সাধারণ কোচগুলিকে উপেক্ষা করার এই নীতি কতটা সরকারের জনদরদি মানসিকতার পরিচয় দেয়? কারণ এমন তো নয় যে, আমজনতার সবাই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরায় ওঠার টিকিট কাটতে পারছেন! তাহলে স্লিপার কোচ কমিয়ে দেওয়ায় যে ক’টি সাধারণ কামরা থাকছে তাতেই মানুষ গাদাগাদি করে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে যাত্রীদের সুরক্ষায় টান পড়ছে, করমণ্ডলের দুর্ঘটনার সময় সাধারণ কামরার যাত্রীদের নিদারুণ পরিণতি এবং মৃত্যুর মিছিল সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই জন্যেই প্রশ্ন আসছে যে ‘বন্দে ভারত’ এবং ‘মডেল স্টেশন’ এই সবকিছুর চাকচিক্যময় প্রচারের আড়ালে কি সাধারণ রেলযাত্রীদের নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্যকে সরকার উপেক্ষা করছে?
‘বন্দে ভারত’ বা ‘বুলেট ট্রেন’ আসুক, কিন্তু কীসের বিনিময়ে তা আসছে সেই বিষয়ে ভারতীয় রেল বা সরকারকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। ইতিমধ্যেই যেমন প্রশ্ন উঠছে ‘বুলেট ট্রেন’-এর জন্য মোদির সরকার জাপানের কাছ থেকে যে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিচ্ছে তা ভারতীয় রেল পরিশোধ করবে কীভাবে? অর্থাৎ, ওই অর্থ কেন্দ্র দিয়ে দেবে না রেলকে নিজে উপার্জন করে ধার মেটাতে হবে? রেলের নিজস্ব পরিসংখ্যানই বলছে, আজকের দিনে রেলকে ১০০ টাকা রোজগার করতে ১০৭ টাকা খরচ করতে হয়। এই অর্থনৈতিক হিসেব ভারতীয় রেলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং সংশয় জাগায় বর্তমান সরকারের ‘ঠাটবাট’-এর নীতি আসলে রেলকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে না তো?
অশ্বিনী বৈষ্ণো, যাঁকে আজকাল বিরোধীরা রেলমন্ত্রীর চাইতে ‘রিল মন্ত্রী’ বলতেই বেশি পছন্দ করছেন, তিনি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, করোনার সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে রেলের এই খরচের হার বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানই তাঁর এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। রেলের রেকর্ড বলছে, ২০১৬ সাল থেকেই রেল ১০০ টাকা আয় করতে ১০০ টাকা খরচ করে বসছে। আদর্শ পরিস্থিতিতে যেখানে ৮০ টাকা খরচ করে ১০০ টাকা রোজগার করা উচিত, সেখানে ভারতীয় রেলের এই ব্যয়বৃদ্ধি কি ‘গ্ল্যামার’ যোগ করতে গিয়ে!
ভারতীয় রেল মানুষের গর্ব এবং দীর্ঘদিন ধরে আমজনতার ভরসার স্থলও ছিল। যেখানে রেলপথে আধুনিকীকরণের কী বেহাল অবস্থা তা সিএজি রিপোর্ট দেখাচ্ছে। গত ৪ বছরে ২৬টি দুর্ঘটনাই বলে দিচ্ছে সব রেল কামরার পরিবর্তন বা আধুনিকীকরণেও সরকার জোর দেয়নি। তাহলে বিত্তবানদের কথা ভাবতে গিয়ে, শুধুমাত্র ‘বন্দে ভারত’-এ জোর দিতে গিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মৃত্যুর মিছিল ঘটলে তো সমালোচনার ঝড় উঠবেই। ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে ভারতীয় রেল ক্ষয়িষ্ণুই হবে।
(লেখক সাংবাদিক)
গৌতম হোড় শুরুটা দেখে কি অনুমান করা যায়, দিনের বাকি সময়টা কেমন কাটবে? যদি তাই-ই…
সানি সরকার, শিলিগুড়ি: স্টেক হোল্টারদের অন্ধকারে রেখে দুই রাজ্যের মধ্যে পরিবহণ চুক্তি বা রেসিপ্রোকাল এগ্রিমেন্ট…
সানি সরকার, শিলিগুড়ি: কোমরসমান জলে দাঁড়িয়ে কেউ ঘরের টিন খুলছেন। কেউ আবার গবাদিপশুকে কোলে তুলে…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির পূর্বাভাস। পাশাপাশি ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পুনে-বেঙ্গালুরু হাইওয়েতে (Pune-Bangalore Highway) দুর্ঘটনা। সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে ধাক্কা মিনি…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রবল বৃষ্টির (Heavy Rain) জেরে ভেঙে পড়ল দিল্লি বিমানবন্দরের (Delhi Airport)…
This website uses cookies.