- গৌতম সরকার
কত কাছে, অথচ কত দূরে। মিল যত, বাঙালি-ওডিয়া অমিল তত। এই যেমন, বাংলা ও অসমিয়া ভাষার সঙ্গে ওডিয়ার এত মিল। কিন্তু লেখার হরফের তেলুগু লিপির সঙ্গে সাদৃশ্য বেশি। রাজনীতির এখনকার সংস্কৃতিতে আবার বাংলা-ওডিশার মিলের শেষ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তনের ডাকে ২০১১-তে ব্যাপক সাড়া দিয়েছিল বঙ্গবাসী। ২০২৪-এ নীরবে বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল ওডিশাবাসী। ২৪ বছরের নবীন-রাজ উচ্ছেদ করে দিয়েছে ইভিএম বিপ্লবে।
সদ্য কয়েকটা দিন ওডিশায় কাটিয়ে মনে হল, ২০১১-তে বাংলার পরিবর্তনের মতো জগন্নাথের রাজ্যে ২০২৪-এর বদলের পিছনেও নেতিবাচক ভোটের ভূমিকা অনেকখানি। বদলানোর মানসিকতা এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, নবীন পট্টনায়েকের সযত্ন লালিত ওডিয়া অস্মিতাও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু অমিল হল, ভুবনেশ্বরে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠার পর একমাসও হয়নি, আক্ষেপ টের পাওয়া যাচ্ছে ইতিমধ্যে।
‘ওই তামিল লোকটা না থাকলে কী এই কাণ্ড হত!’ চন্দ্রভাগা সৈকতে ফলের রস বিক্রেতার কথায় যেন পস্তানোর সুর। সামনে বিজু পট্টনায়েকের পূর্ণাবয়ব মূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের মতো গরিবদের জন্য নবীনবাবু অনেক করেছেন।’ তাহলে বদল এল কেন? ফিরে যেতে হয় ২০১১-র বাংলায়। মমতা পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন সত্য। কিন্তু বাংলা পরিবর্তন ঘটাতে মুখিয়েই ছিল। ক্ষেত্রটা প্রস্তুত হয়েছিল।
বাম রাজত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়তে শুরু করেছিল আরও আগে। ২০০৮ থেকে ইঙ্গিত মিলছিল। তৃণমূল নেত্রী ক্ষোভের সলতেটা পাকিয়েছিলেন মাত্র। তার আগে ক্ষোভ থাকলেও বিকল্প পাচ্ছিল না বাংলার মানুষ। ২০১১-তে অনেকটা নিরুপায় হয়ে ইভিএমে ঘাসফুলের বোতাম টিপে ঝড় তুলেছিলেন বাংলার বাসিন্দারা। ততদিনে বিকল্প হিসেবে কিছুটা আস্থা অর্জন করে ফেলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জিআই ট্যাগ পাওয়ার জন্য যত প্রতিযোগিতাই থাক, রসগোল্লাকে কেন্দ্র করে মিল আছে প্রতিবেশী এই দুই রাজ্যের। যদিও স্বাদে, রঙে অনেক অমিল বাংলার রসগোল্লার সঙ্গে। কটক থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়ার পথে পাহাল নামে একটি গ্রামে বাংলার বর্ধমানের শক্তিগড়ের ল্যাংচা হাবের মতো রসগোল্লা হাব আছে। বাঙালির জিভ সেই রসগোল্লায় তৃপ্ত হয় না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অবশ্য সেই রং, স্বাদের ব্যতিক্রম ও সাযুজ্য, দুই-ই আছে।
বাংলায় বাম জমানার প্রতি মানুষের রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে। তৃণমূলের বিপুল জয়ের পিছনে নেতিবাচক ভোটের ভূমিকা ছিল। ওডিশাতে ২০২৪-এ যেন তার পুনরাবৃত্তি। বিজু পট্টনায়েকের পুত্র নবীন ওডিশা অস্মিতার কেতন উড়িয়ে যে আবেগ তৈরি করেছিলেন, তা ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। কিন্তু কংগ্রেস সেখানে নিজেদের নির্ভরশীল বিকল্প হিসাবে দাগ কাটতে পারেনি জনমনে।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও অনেক রাজ্যে কংগ্রেসের ভালো সাফল্য এলেও ওডিশায় তার ছাপ পড়েনি। নিজের রাজত্ব নিষ্কণ্টক রাখতে সরাসরি এনডিএ’র শরিক না হয়েও বিজেপির হাত ধরে এতকাল চলেছেন নবীন পট্টনায়েক। বাবার মৃত্যুর পর দুন ও দেরাদুন স্কুলের এই প্রাক্তনী হঠাৎ রাজনীতিতে এলেও ভোটের ছক্কা-পাঞ্জায় তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি স্পষ্ট বরাবর বিজেপির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্যে।
নির্মল সখ্যে কখনও বিশ্বাস নেই বিজেপির। বরং বন্ধুতার আড়ালে সহযোগী দলে ভাঙন ধরানো, সমর্থনের ভিত ক্ষইয়ে দেওয়া পদ্ম শিবিরের পরিচিত ছক। মহারাষ্ট্রের এনসিপি ও শিবসেনায় ফাটল ধরানো বিজেপির সেই কর্মধারার সর্বশেষ উদাহরণ। বিজু জনতা দলের মুকুটহীন সম্রাট ওডিশায় বিজেপির সেই কর্মধারা যখন টের পেলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া তিনি আঘাত দিয়ে ফেলেছিলেন নিজেরই তৈরি ওডিশা অস্মিতায়।
প্রাক্তন আমলা তামিল জনগোষ্ঠীর ভিকে পান্ডিয়ানকে কার্যত নিজের রাজনৈতিক উত্তরসূরি ঘোষণা নবীনের দলের জন্য আত্মহত্যার শামিল হয়েছে। ভোট চুকেবুকে গেলেও ওডিশার পথেঘাটে সেই একই আলোচনা। গাড়ির ড্রাইভার থেকে পাহাল গ্রামে রসগোল্লার দোকানদার, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইত কিংবা চন্দ্রভাগা সৈকতের ফোটোগ্রাফার, সকলের মুখে একই ভাষা, ‘তামিল লোকটা ডুবিয়ে দিলেন।’
কেউ কিন্তু পান্ডিয়ানের নাম নেন না। কিন্তু ‘তামিল লোকটা’ কতটা ভিলেন, তা বোঝা যায় পথেঘাটে। তবে পান্ডিয়ানের জন্যই যে শুধু নবীনকে ঝেড়ে ফেলেছে ওডিশাবাসী, তা কিন্তু নয়। ডাল মে আউর বহুত কুছ কালা হ্যায়। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের মতো। সেই ঔদ্ধত্য, সেই দুর্নীতি, সেই নেতাদের বিলাসবহুল জীবন, সেই কাটমানির কাহিনী। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেকারত্ব। গত পাঁচ-ছয় বছর ওডিশাতেও বাংলার মতো সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ।
রাস্তাঘাট, সেতু, বাসস্ট্যান্ড, চিকিৎসা ইত্যাদিতে অনেক পরিকাঠামো উন্নয়ন হলেও শিল্প সেই হাতেগোনা পুরোনোগুলি। লেখাপড়া জানা নবীন প্রজন্মের তাই অসন্তোষ স্বাভাবিক। ওডিশায় মানুষ ধর্মপ্রাণ। মন্দিরের ছড়াছড়ি। দেবতার থানে মাথা না ছুঁইয়ে কোনও কাজ করেন না ওঁরা। যেটুকু জীবিকার সংস্থান, তা ওই দেবভূমিগুলির সৌজন্যেই। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, পুরীর অর্থনীতির ৮০ শতাংশ আসে ধর্মীয় পর্যটন থেকে।
শুধু পুরী নয়, ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ, কটকের ধবলেশ্বরের মতো রাজ্যের আনাচে-কানাচে নানা মন্দিরে সবসময় ভিড় স্থানীয় অর্থনীতিকে পুষ্ট করছে। ব্যতিক্রম পশ্চিম ওডিশার কালাহান্ডি, সুন্দরগড়, বোলাঙ্গিরের মতো কিছু জেলা, যেখানে জীবিকা তেমন কিছু নেই। ওডিশা অস্মিতা খিদের কাছে ফিকে এই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। সেই সুযোগে বিজেডি’র ঘরে সিঁধ কেটে ঢুকে নবীনের ভোট চুরি করেছে বিজেপি।
সরকার পরিচালনায় দলের নেতাদের পাত্তা না দেওয়াই নবীন (পট্টনায়েক) সংস্কৃতি। তিনি সরকার চালাতেন আমলাদের দিয়ে। কিছুটা যেন মমতা মডেল। কিন্তু জনপ্রতিনিধি, দলের নেতাদের লাগাম টানেননি কখনও। যা এখন মমতা চেষ্টা করছেন অন্তত আপাতভাবে। ফলে শাসক নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি, ঔদ্ধত্যের নানা গল্প ওডিশার সর্বত্র। কটকের সেক্টর ১০-এর রাস্তায় এক শিক্ষকের কথায় মনে হল, উনি পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছেন। ‘বুঝলেন, এখানে টাকা না দিলে কোনও কাজ হয় না।’
এখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, এ রাজ্যে পুলিশও টাকা তোলে। থানার আইসি, জেলা শাসক, মহকুমা শাসকদের শুধু টাকার ধান্দা। ভুবনেশ্বরে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠার পর হঠাৎ খবরে এসেছে একটি সরকারি বাংলো। বিধায়ক হিসেবে বাংলোটি পেয়েছিলেন বিজেডি’র সাংগঠনিক সম্পাদক প্রণব প্রকাশ দাস। লোকসভা নির্বাচনে তিনি ধর্মেন্দ্র প্রধানের কাছে হারার পর ওডিশা সরকার তাঁকে বাংলো ছাড়ার নোটিশ দিতে তিনি হঠাৎ বাংলোয় ভাঙচুর শুরু করেছেন।
রহস্যটা কী? ভাঙা হচ্ছে বাংলোর মূল কাঠামোর অতিরিক্ত অংশ। যেখানে লুকিয়ে বিজেডি নেতার বৈভবের রহস্য। ঢাকঢাক গুড়গুড় এমনই যে, ভাঙাভাঙির ছবি তুলতে গেলে পাশের বাংলোর অধিপতি প্রাক্তন মন্ত্রী রঘুনন্দন দাস চিত্র সাংবাদিকের দিকে পোষা কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলেন। বিজেপি চাইলে বিজেডির অনেক নেতার কপালে সিবিআই-ইডি আছে নিঃসন্দেহে। সেটা বোঝেন বলেই বিরোধী দলনেতা হয়ে প্রথম থেকে বিজেপি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলছেন নবীন।
রাজনৈতিক সৌজন্যের মোড়কে ধান্দা, অন্যায়, লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় বিজুর নামাঙ্কিত দলটাই না সাইনবোর্ড হয়ে যায় ভবিষ্যতে। কোনারক মন্দিরের সামনে এক ব্যবসায়ীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘ওডিশার সঙ্গে বিজেপির সংস্কৃতির মিল তেমন নেই বটে, কিন্তু নবীনবাবুর ঘুরে দাঁড়ানোটাও সহজ নয়।’ অনেকটা বাংলার সিপিএমের মতো। তৃণমূলকে অপছন্দ হলেও সিপিএমের কথা ভাবছে না বঙ্গবাসী।