- পরাগ মিত্র
বর্ষার আকাশের নীচে পলকেই ছাই ‘হলং’। বিলাপও নির্ঝর। এই বেদনা বিধুরতার স্বাভাবিক ভিত্তি আছে। শুধু ভিজিটর্স বুকের গরিমার জন্য নয়, প্রান্তিক উত্তরে জলদাপাড়ার গহিনে উনিশশো সাতষট্টির আট কামরার ঠাঁই স্ব-আভিজাত্যেই উত্তরের জনমনে ‘মেরে পাস হলং হ্যায়’ উচ্চারণের শ্লাঘা। যে ত্রিসীমানায় আসেনি, তারও।
আনাচকানাচ প্রকাশ্যে উত্তরবঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলো থেকে প্রাসাদ, সেতুতে কত কথকতা বিছিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের অনুভবের কাছে কতটুকু? দুঃখের হলেও অনস্বীকার্য যা হারিয়ে গেল তার হিসেব মেলানো ভার।
ব্রিটিশ আভিজাত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিংহাসন অস্বীকার করেও অষ্টম এডওয়ার্ড প্রেমিকা ওয়ালিস সিম্পসনকে আঁকড়ে থাকলেন। নতুন রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেকের সম্মানে তিস্তায় নির্মিত হল করোনেশন সেতু – আজও বৃহত্তর বাংলাযোগে ডুয়ার্সের জিয়নকাঠি। উৎকণ্ঠা এই সেতু নিয়েও। বিধিনিষেধের লোহার বার উধাও। বিচূর্ণ হলে হাহাকার থাকবে ততক্ষণ যতক্ষণ না নতুন ঘটনা ভাইরাল হয়।
আগুন লাগেনি আগে ভুটানঘাট, জয়ন্তী, লাভা, সামসিং, রাজেশ্বরী বিল্ডিং, একাধিকবার জলঢাকায়? সঞ্জাত ক্রোধেও পলি। অভিযুক্তরা পরে ভোটে জিতে পাইলট কারওয়ালা কেষ্টবিষ্টু হয়েছে।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের নানা নিদর্শন কি আপামরের অনুভবে সমানভাবে দোলা দেয়?
বিগত সাধারণ নির্বাচনে সাদা খাতার ব্যয়ও ১.৩৫ ট্রিলিয়নের বেশি। ইতিহাস রক্ষা অ্যাজেন্ডায় কতটা? এসেছে ঐতিহ্য রক্ষার প্রাসঙ্গিকতা? বাণেশ্বরের ‘মোহন’, চিলাপাতার ‘নল রাজার গড়’ বা রাজাভাতখাওয়ার ট্রেনিং সেন্টারের শতবর্ষ পেরোনো কাঠের বাংলো, রায়মাটাংয়ের বাংলো নিয়ে বৈঠকি সভাও কি হয়েছে? আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে প্রশ্ন করবেই আমরাও কি চেয়েছি?
তবুও যা আছে তার যথাযথ সংরক্ষণেও কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট উদ্যোগী তো? রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সাইটই কি শেষ সত্য? মালবাজারের জাহাজবাড়ির ঐতিহ্য, চালসার পাদ্রি সাহেবের কুঠি, নাগরাকাটার জাদুকোঠির বিশ্বাস অবিশ্বাসের পরাবাস্তব প্রহেলিকা, সাওগাঁর মতো ছোট বিমান অবতরণভূমি, কুমারগ্রামে নদীর চরে জেগে ওঠা হামি রাজার গড়, শিলিগুড়ির টেনিস ক্লাব, টাউন স্টেশনের সামনে আমাদের ভূমিকা খুব খারাপ।
ঐতিহ্য সংরক্ষণে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা, সংরক্ষণ, সামর্থ্য বৃদ্ধি, যোগাযোগ, জনগণ-অভিমুখ করেছিল, যাতে জীবনে জীবন যোগ দৃঢ় হয়। বৈচিত্র্যের অন্বেষণ ও উপলব্ধি হোক এবছরের আহ্বান।
ভালো আছে টাউন হল- গোসানিমারি মন্দির- রাজাগণ বোর্ডিং, বাধনা ঘাট? কোচবিহার স্টেট রেলওয়ে জয়ন্তী পর্যন্ত ছিল। বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে মেটেলিতেও। ডুয়ার্সজুড়ে বাগানে ছড়িয়ে আছে অভিবাসন থেকে নানা ইতিহাস। ডুয়ার্সের খুঁটির উপর কাঠের বাড়ির দখল নিচ্ছে কংক্রিট। টং ঘরে চিলের কান্না। মাথা কুটলেও পাওয়া যাবে না অজস্র পুরোনো দালান, মালবাজারের পোলো খেলার মাঠ, গেইলিখোলা রেলপথ। রাজার বাড়ির তোপ গিয়েছে পার্কে। কিছু হয়তো প্রয়োজনে অনন্যোপায়। কিন্তু স্মারকের গুরুত্ব না বোঝার অনবধানতাও কি দায়ী নয়?
যেটুকু আছে তাও কিন্তু কম নয়। বিলীন হওয়ার আগে রক্ষাই হোক অঙ্গীকার। আধুনিক প্রযুক্তি গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিকতম হোক সংরক্ষণ। পোস্টমর্টেমের কমিটি নয়।
নতুন নির্মাণ করুক। স্টিকার পরিবর্তন নয়। বিদ্যালয়ের পোশাকগুলোও ঐতিহ্য- এ বোধের লালন হোক।
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক)