- অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
নায়ক আর অভিনেতা নিয়ে একটা বিতর্ক চলে, চলতে থাকবে, এ বিতর্ক থামার নয়। কিন্তু এর মাঝেই ওই নায়ক, স্টার, স্টারডম উবে যাচ্ছে খেয়াল করেছেন?
নায়ক বা খলনায়ক এবং অভিনেতার মধ্যে তফাৎটা কোথায়? নায়ক বা খলনায়ক যা করেন সেটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে আর অভিনেতাকে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হয়। ধরুন শোলে’র ধর্মেন্দ্র বা অমিতাভ বচ্চন। ট্যাংকের ওপরে ধর্মেন্দ্র ‘সুইসাইড’ ‘সুইসাইড’ বলে চিৎকার করছেন, এধারে আড়চোখে সেটা দেখে জিগরি দোস্ত বলছেন, নৌটঙ্কি কর রহা হ্যায় শালা।
ঘটনা, ডায়ালগ, রিঅ্যাকশন কোনও একটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? নয়, কিন্তু লক্ষ কোটি মানুষ দেখেছেন, হেসেছেন, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্নই নেই। কারণ ধর্মেন্দ্র-অমিতাভ হিরো। ওই ছবিতেই গব্বর সিং, ওভাবে লোকজন কথা বলে নাকি? কিন্তু তিনি ওভাবে কথা বলেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠলেন, আমরা যখন গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরে নওয়াজ বা মনোজ বাজপেয়ীকে দেখি, তখন চরিত্রকে দেখি। নায়ক বা খলনায়ক নয়। বহু বহু ছবিতে এই উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। পুষ্পা বলে অমন এক ঘাড় বাঁকানো রাজেশ খান্না, বিশ্বাসযোগ্য? হ্যাঁ, কারণ উনি নায়ক। ওরকম করে আর কাউকে বলতে বলুন, মানুষ ঢিল ছুড়বে। আবার সলমন খানের পাশে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী– নওয়াজুদ্দিনকে সারাক্ষণ লড়ে যেতে হচ্ছে চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য। মানুষ দুটোই পছন্দ করে, কিন্তু সেই মানুষই হিরো আর অভিনেতাদের আলাদা করেই দেখে। কাজেই একটা ছবিতে তেমন কোনও নায়ককে নিলে প্রযোজকের লাভ, রজনীকান্ত থাকলেই তো হল, বক্স অফিস তো আগেই গরম।
রোবট ছবিটা সেদিন আরেকবার দেখলাম, একটা জায়গাও বিশ্বাসযোগ্য নয় যদি না আপনি আগে থেকেই রজনীকান্তকেই হিরো বলে মেনেই নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই স্টারডম ভাঙছে, মানুষ কোথাও গল্প দেখতে চাইছেন, কাজেই সেই চরিত্র হয়ে উঠতে হচ্ছে, তার জন্য অভিনেতাদের ডাক পড়ছে, কনটেন্ট ইজ দ্য কিং, বিষয়বস্তু নিয়ে সারা দুনিয়ার এন্টারটেইনমেন্ট শিল্প বিনোদন দুনিয়া ভাবতে শুরু করেছে, কারণ বিরাট সংখ্যক পাবলিক এখন হিরো নয়, বিষয়, গল্প, অভিনয় খুঁজছেন। উত্তমকুমারকে নায়ক বলা হয়, মহানায়ক। আমার তো মনে হয় নায়কের ক্ল্যাসিকাল ডেফিনেশন অনুযায়ী দেব বা জিৎ অনেক অনেক বড় নায়ক। কারণ উত্তমকুমার প্রতিটা ছবিতে অন্য অন্য ম্যানারিজম, চরিত্রের অন্য দিকগুলো নিয়ে এক বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন চিরটাকাল। উনি যা করছেন, মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে নিচ্ছেন এমনটা কি হয়েছে? তাঁর অভিনীত বাজে ছবি ফ্লপ করেছে, চূড়ান্ত ফ্লপ। রজনীকান্তের ফ্লপ ছবি দেখান। দেব চাঁদের পাহাড় করছেন, উনি করছেন, মানুষ বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন। যা করছেন, যে উচ্চারণে কথা বলছেন, মানুষ মেনে নিচ্ছেন, বিশ্বাস করছেন, এটাই স্টারডম।
উত্তমকুমারকে প্রতিটি ছবিতে চরিত্র হয়ে উঠতে হয়েছে, অন্তত উনি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটা ছবিতে পুষ্পা না থাকলেও ঘাড় ব্যাঁকাতে হয়নি। ওই যে হাত বাড়িয়ে অমিতাভের হ্যাঃ বলা, সেটা ছিল এক নায়কের কারবার, কিন্তু ব্ল্যাক থেকে দেখতে শুরু করুন ওঁর ছবিগুলো, উনি নায়ক থেকে অভিনেতা হয়ে উঠছেন, বড় কঠিন, কিন্তু হয়ে উঠেছেন।
দেব বা জিৎ বাংলার সেই অর্থে নায়ক, যাঁদের এই দায় ছিল না, তাঁরা বাঘা যতীনই করুন আর কবীর, অসুর করুন বা প্যান্থার, তাঁরা নায়ক, কারও বাজে লাগতেই পারে। কিন্তু ওঁরা যা করেছেন পাবলিক গুরু গুরু বলে মেনেছে, উত্তমকুমারের সেই সৌভাগ্য ছিল না।
লার্জার দ্যান লাইফ? কোথায়? প্রতিটা ছবিতেই উত্তমকুমার চরিত্র অথচ খামোখা নায়ক, মহানায়ক ট্যাগ জুড়ে গেল তাঁর নামের সঙ্গে। উত্তমকুমারের ক’টা ছবি হবার আগে দু’- আড়াই লাখেরও গ্যারান্টি পেয়েছে? ছবি রিলিজের আগে টেনশনে কথা বন্ধ করে দিতেন প্রযোজক, ডিরেক্টর? দেব এবং জিৎ-এর ছবি হওয়ার আগে প্রি সোল্ড হয়েছে, হয়ে যায়। বিক্রি হয়ে গিয়েছে টেলিভিশন স্বত্ব। মানে যা করবেন পাবলিক দেখবে। কিন্তু ওই যে বললাম এই স্টারডম, আমাদের দেশের দক্ষিণ ছাড়া বাকি দেশ-বিদেশের সব জায়গাতেই ধসে যাচ্ছে বললেও কম বলা হয়।
শর্ত, অভিনেতা হয়ে উঠতে হবে, আপনি যা করবেন, মানুষ সেটাতেই হাততালি দেবেন, এটা আর হবে না। হিন্দি ছবিতে এক ঝাঁক নতুন অভিনেতা এসেছেন। ক’জন রাজেশ খান্না? জিতেন্দ্র? ধর্মেন্দ্র? ঋষি কাপুর? তাঁদের অনেকেই অভিনয়ের ফর্মাল ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন, কাজেই একটা মারাত্মক গুলিগোলা চলছে এমন সিনে যে হাতে গুলি লেগেছে সেই হাতে গুলি চালাতে অস্বীকার করছেন। সব মিলিয়ে স্টারডমের দফারফা। তা বলে কি এক ধাক্কায় শেষ হয়ে যাবে? না তা নয়, কিন্তু নায়কের জমানা শেষের দিকে, অভিনেতারাই হয়ে উঠছেন নায়ক, বহুকাল আগে যা হয়ে দেখিয়েছিলেন উত্তমকুমার।
(লেখক সাংবাদিক, পরিচালক)