- দেবদূত ঘোষঠাকুর
২০২০ সালের জুলাই মাসের কথা। দেশে লকডাউন চলছে। রাস্তাঘাট শুনসান। তিন মাস পুরো বন্ধ থাকার পর ব্যবসা-বাণিজ্য সবে শুরু হয়েছে। সব থেকে বিপর্যয়ের শিকার রাস্তার ধারের হকাররা। বিশাল সংখ্যক হকারের মন রাখতে কিছু ‘কল্যাণমূলক’ কর্মসূচি হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। পাঠক মনে রাখবেন তার পরের বছরই কিন্তু ছিল রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন।
ওই কর্মসূচির প্রাথমিক ধাপ হিসেবে কলকাতা শহরে হকার-সংখ্যা ঠিক কত, তা জানতে সমীক্ষা শুরু হল। সমীক্ষার তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কলকাতা পুরসভার চিফ ম্যানেজার (মার্কেট)-কে। তাঁকে সাহায্য করতে পুরসভার বিভিন্ন বিভাগের আরও ৬২ জন আধিকারিককে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল ধাপে ধাপে রাজ্যের অন্য পুর এলাকাগুলিতে ও এই ধরনের সমীক্ষা চালানো হবে।
কলকাতা পুরসভার সেই সমীক্ষা কবে শেষ হল, কবে রিপোর্ট পেশ হল সেই তথ্য পুর ভবনে অনেক খোঁজ নিয়েও জানা সম্ভব হয়নি। আর কলকাতার সমীক্ষা শেষ না হওয়ায়, অন্য পুর এলাকায় কোনও সমীক্ষাই হয়নি। কলকাতায় হকার না সরলে শিলিগুড়ি, মালদা, কোচবিহার, আসানসোল, বর্ধমানে হকার সরবে কী করে? কলকাতায় বাড়লে এসব শহরেও বাড়বে, কলকাতা সাফ হলে ও সব শহরও সাফ হবে।
কলকাতা শহরে হকারের আনুমানিক সংখ্যা ঠিক কত?
পুরসভায় বছর পাঁচেক আগে একবার হকার-সমীক্ষা শুরু হয়েছিল। তখন ৫৯,৫০২ জন পরিচয়পত্র পাওয়ার আশায় আবেদনপত্রও জমা করেছিলেন। এক কর্তার কথায়, ‘তখন টাউন ভেন্ডিং কমিটিও তৈরি করা হয়েছিল পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে অনিয়মের অভিযোগে আদালত কমিটি খারিজ করে দেয়।’ এরপর আর এ বিষয়ে পদক্ষেপ করা হয়নি। তাই হকারের সঠিক সংখ্যাটা তখন জানা যায়নি।
লালবাজারের খবর, ২০১৫ সালে পুরসভার সঙ্গে প্রতিটি থানা তাঁদের নিজের এলাকার ভিডিওগ্রাফি করেছিল। এলাকায় কত হকার ব্যবসা করত তার হিসেব আছে প্রতিটি থানার কাছে। ভিডিওর পাশাপাশি হকারের বসার জায়গা, নাম, ঠিকানা, পরিচয়পত্র রয়েছে পুলিশের কাছে। এবার পুলিশের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বর্তমান পরিস্থিতিরও ভিডিওগ্রাফি হবে। একইসঙ্গে বর্তমানে ব্যবসা করছেন এমন হকারদের পরিচয়পত্রও নেওয়া হবে। গত ন’বছরে প্রতিটি থানা এলাকায় কত হকার বৃদ্ধি পেয়েছে তার রিপোর্ট তৈরি করবে লালবাজার। একইসঙ্গে কলকাতা পুরসভার সঙ্গেও যৌথভাবে আরও একটি সার্ভে করবে পুলিশ। সেই রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো জমা পড়বে নবান্নে। তবে কলকাতায় মোট হকারের সংখ্যাটা কিছুতেই প্রকাশ করেননি লালবাজার কর্তৃপক্ষ।
২০০৫ সালের একটি হিসেব অনুযায়ী, কলকাতার হকারদের সংখ্যা ২ লক্ষ ৭৫ হাজার। আর তাঁদের মোট ব্যবসার পরিমাণ ৮,৭৭২ কোটি টাকা (২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। কলকাতা শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ ফুটপাথ হকার ও বেআইনি দখলদারদের কুক্ষিগত। পৃথিবীর অনেক দেশেই হকাররা ফুটপাথ ও অন্যান্য প্রকাশ্য স্থান দখল করে নিজেদের ব্যবসা চালান। কিন্তু কলকাতায় হকারদের সংখ্যাধিক্য বারবার শুধু প্রশাসন নয়, আদালতেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০১৫ সালের সমীক্ষায় জানা যায় হকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩ লক্ষ। হকারদের সঙ্গে যুক্ত ছিল মোটামুটি ১৫ লক্ষ মানুষের জীবন।
২০০৫ সালের পর কলকাতা পুরসভার তরফে বেশ কিছু নিয়ম জারি করা হয়। কসবার মতো কিছু জায়গায় হকারদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়। তবে পুনর্বাসন দেওয়া জায়গাগুলিতে কেনাবেচার পরিমাণ খুবই কম বলে হকারদের তরফে জানানো হয়েছে। আবার বাগবাজারের খালপাড়ে তৈরি হওয়া পুনর্বাসনকেন্দ্রে কোনও হকার যাননি একদিনের জন্যও। সেগুলি এখন ভবঘুরের আড্ডা। বামফ্রন্ট পুর বোর্ডের পরে তৃণমূল বোর্ড ও ওই পুনর্বাসনকেন্দ্রে হকার বসাতে পারেনি। যদিও নতুন রাস্তা জবরদখল করে হকার বসানো ঠেকানো যায়নি।
হকার তোলার মতো যেসব অভিযান কলকাতা শহরে হয়েছে, সেগুলির কোনওটাই কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাতারাতি রাস্তার ধারের স্টলগুলি তুলে দিয়েও শেষপর্যন্ত দখলমুক্ত রাস্তা বা ফুটপাথ ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি। বামফ্রন্ট আমলে সব থেকে বিষ্ময়কর কর্মকাণ্ড বোধহয় ছিল ১৯৯৬ সালের হকার উচ্ছেদ অভিযান ‘অপারেশন সানশাইন’।
সেবার সিপিএম নেতা মেয়র পারিষদ কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় নিজে বুলডোজারে বসে গড়িয়াহাট, লেক মার্কেট, রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে হকার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একরকম হঠাৎ করেই শুরু হওয়া ওই অভিযানে হকাররা বাধা দেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পাননি। এক রাতে সাফ হয়ে যায় ম্যান্ডেভিলা থেকে গোল পার্ক পর্যন্ত দুই দিকের ফুটপাথ। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় রাসবিহারী মোড় থেকে বিজন সেতুর মুখ পর্যন্ত রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশের অবৈধ ঝুপড়ি। ওই অভিযানে বুলডোজারের চালকের বয়স এখন আশি ছুঁইছুঁই। ওই অভিযানের স্মৃতি এখনও পরিষ্কার। গড়িয়াহাটের একডালিয়ার বাসিন্দা ওই বৃদ্ধ সেদিন ভেবেছিলেন হকারদের থেকে বড় বাধা আসবে। বুলডোজারের সামনে হয়তো বুক পেতে দেবেন হকাররা। তাই কান্তিবাবু নিজে সওয়ার হয়েছিলেন বুলডোজারে। কোনও প্রতিবাদই হয়নি।
ওই অভিযানের প্রত্যক্ষদর্শী এই প্রতিবেদকেরও ওই রাতের স্মৃতি এখনও অমলিন। অভিযানের পরের দিন একডালিয়ার উলটোদিকের ফুটপাথে তৎকালীন কংগ্রেস সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাড়ি-জামা বিক্রি করে ওই উচ্ছেদ অভিযানের প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
ওই ঘটনা ঠিক ছিল না ভুল, তা নিয়ে তৎকালীন শাসক বামফ্রন্টের মধ্যে তীব্র মতানৈক্যে অভিযান আর ধর্মতলা, পার্ক সার্কাস, শিয়ালদা, রাজাবাজার, তপসিয়া-তিলজলা, গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজে পৌঁছায়নি। বছরখানেকের মধ্যে গড়িয়াহাট, কালীঘাট, রাসবিহারী, হাতিবাগানের ফুটপাথ ফের দখল হয়ে যায়। নীরব দর্শক হয়ে সেই দখল অভিযানে সম্মতি জানায় শাসক জোট। আর তারপর থেকেই হকারদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার শুরু করে আইএনটিইউসি। বর্তমানে ওই সংগঠনের পুরোটাই গিয়ে ভিড়েছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনে।
এবারের হকার উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর আগেকার অভিযানের বড্ড বেশি মিল। এবারেও বুলডোজারের চালকের আসনে শাসকদল। আর যাদের রুজি-রোজগারের একমাত্র অবলম্বন গুঁড়িয়ে গিয়েছে তাঁরা ও শাসকদলের পতাকা বাহক। সেবারের মতো এবারেও অভিযান শুরু হতে হতেই শেষ হয়ে গিয়েছে। বছর দুয়েকের মধ্যে ফের দখল হয়েছে ফুটপাথ। আসলে ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। হকার সমস্যার সমাধানের মতো, ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখার স্বপ্ন কি কখনও বাস্তবায়িত হবে?
আসলে হকার আর শাসকদলের ক্যাডার যে সমার্থক শব্দ। কারণ ভোট বড় বালাই। ফলে হকারদের নিয়ে আজকের শাসক যা বলে, তা বিরোধী থাকার সময় বলে না। আবার আজকের বিরোধীরা শাসক থাকার সময় অন্য কথা বলেছিল। এটা শুধু বাংলা নয়, সব রাজ্যেই প্রযোজ্য।
হকারদের কেন্দ্রীয় সংগঠন হকার সংগ্রাম কমিটির যেসব নেতার উত্তরণ প্রায় ৪০ বছর আগের অপারেশন সানশাইন থেকে, তাঁদের অনেকেই বলছেন, শুধু যদি উচ্ছেদ করা প্রশাসনের লক্ষ্য হয় তাহলে তা সম্ভব। কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া হকারদের পুনর্বাসন যদি সমাধানের বৃহত্তর লক্ষ্য হয়- তা কখনও সম্ভব নয়। শহরের বুকে তেমন জমি কোথায়? ওই হকার নেতারা আশঙ্কা করছেন হকারদের রাজনৈতিক ‘লাভ’ হিসেবে দেখলে ‘উচ্ছেদ’ , ‘পুর্নবাসন’- এই সব কথাগুলি ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
২০১৫ সালের কলকাতা পুরসভার নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাসের ভিডিও এখনও ঘুরছে হকার নেতাদের অনেকের হাতে হাতে। সেখানে প্রকাশ্য সভায় হকারদের একগুচ্ছ সুবিধা প্রদানের ঘোষণা করে হকারদের ফুটপাথ থেকে উচ্ছেদ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। হকারদের একটা বড় অংশ মনে করছেন ওটাই মমতার আসল মুখ। তাই ফের ফুটপাথের দখল তাঁদের হাতেই ফিরবে বলে মনে করেন হকার্স নেতারা। একটা নির্বাচনের জন্য শুধু অপেক্ষা মাত্র।
(লেখক সাংবাদিক)