আর কি কেউ সাগিনা মাহাতোর মতো সিনেমা বানাবেন? উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের শ্রমিক আন্দোলনের লড়াইকে তুলে ধরতে দিলীপকুমারের মতো বলিউডের কোনও সুপারস্টার রাজি হয়ে যাবেন?
কিংবা ধরে নেওয়া যাক, কেন বলিউডে আর ‘নমক হারাম’-এর মতো সিনেমা তৈরি হয় না, যেখানে কারখানার মালিকের বন্ধু মালিকের স্বার্থে শ্রমিক কলোনিতে থাকতে এসে কখন যেন নিজেই শ্রমিক দরদি হয়ে উঠবেন!
একবার মনে করার চেষ্টা করে দেখা যাক, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত, গুলজারের চিত্রনাট্যে রাজেশ খান্না আর অমিতাভ বচ্চনের যুগলবন্দিতে ‘নমক হারাম কী অসাধারণ ছবি ছিল। রাজা মুরাদের জীবনের সেরা চরিত্রায়নে আলম হিসেবে লেখা তার গান যখন পর্দায় রাজেশ খান্না গেয়েছেন, তখন কীভাবে দর্শকদের চোখ জলে ভিজে যেত। বলিউড কেন আর শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সিনেমা বানায় না, সেটা বুঝতে পারলে আমরা অনুধাবন করতে পারব মে দিবস কেন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
শুধু বামেদের ক্ষয় নয় বা পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির জনভিত্তিতে ধস নামা নয়, আসলে মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে উদার অর্থনীতির সুরকি বিছানো পথে যেদিন থেকেই ভারতবর্ষ হাঁটতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই মে দিবস পালন কিংবা শ্রমিকের অধিকারের কথা বলা ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শা’রা এতটাই শিল্পপতিদের ‘বন্ধু’ যে, আজকের ভারতবর্ষে আর শ্রমিকের অধিকার বা মে দিবস উদযাপনটা রাজনৈতিকভাবে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নেই। এমনকি করোনার সময় উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার শ্রম আইন বদলে কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়ার পরেও তেমন প্রতিরোধ বা শ্রমিক আন্দোলন কোথায় দেখা গিয়েছিল!
ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি যখন প্রকাশ্যে ভারতে সপ্তাহে একজনের অন্তত গড়ে ৭০ ঘণ্টা কাজ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন, তখনও সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলি তেমন কিছু বলতে পেরেছিল কি? এটা আলাদা সত্য যে, নারায়ণ মূর্তির জামাই, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক খাস বিলাতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে তেমন দমাতে পারেননি। বরং সমস্ত রাজনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ঋষি সুনক আগামী নির্বাচনে বিলাতের ‘বাম শক্তি’, অর্থাৎ লেবার পার্টির কাছে গোহারা হারতে চলেছেন।
কিন্তু এদেশে বামেরা কি শ্রম আইন পরিবর্তন বা তথ্যপ্রযুক্তির কর্তাদের ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’-এর নীতি বা যখন খুশি ছাঁটাইয়ের ঘোষিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তেমনতর জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে? ঐতিহাসিকভাবে এটাই সত্যি যে, পশ্চিমবঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে আহ্বান করতে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাম সরকারই ইনফোসিস, উইপ্রোর মতো সংস্থাগুলিকে ‘সেজ’ বা ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ গড়ার অনুমতি দিয়েছিল। অর্থাৎ আজ নারায়ণ মূর্তি বুক বাজিয়ে যেটা বলছেন, সেটাই কার্যত দুই দশক আগে পশ্চিমবঙ্গে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার নামে আইটি কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বামেদের তুলনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বাম বলেই তৃণমূল সরকারের তেরো বছরের শাসনকালে কোনও ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ গড়ে তোলার অনুমতি দেননি। তাঁর সরকারের শ্রম দপ্তর ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’-এর নীতিরও বিরোধী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী বলে পরিচিত এবং শ্রমিক নেত্রী দোলা সেন প্রতি বছর তৃণমূল ভবনে মে দিবস পালন করেন, এই বছরও করেছেন।
কিন্তু সত্যিই কি এখনও পশ্চিমবঙ্গে মে দিবস সেইরকম গুরুত্ব পায়? উত্তরবঙ্গে ভোট প্রচার দেখতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি চা-বাগানের শ্রমিক বস্তিতে এখন আর লাল পতাকা উড়তে দেখা যায় না, কিংবা শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সরব নেতাদের উপস্থিতিও নগণ্য। উত্তরবঙ্গে গেরুয়া শিবিরের দাপট বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী শ্রমিক এলাকায় বরং আরএসএস বা তাদের শাখা সংগঠন বনবন্ধু কল্যাণ পরিষদ বা ফ্রেন্ডস অফ ট্রাইবাল সোসাইটির (এফটিএস) প্রবল উপস্থিতি চোখে পড়ে। চা-বাগান কিংবা উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার পতাকা যত পতপত করে ওড়ে, বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা কি ততটা আলোচিত হয়?
ব্যক্তিগতভাবে যদি একটু ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাই, তাহলে আরএসএসের শ্রমিক নেতা এবং তাত্ত্বিক দত্তোপন্থ ঠেংড়ির কথা মনে পড়বে, যিনি বাজপেয়ী জমানায় সর্বদা শ্রমিকের অধিকার রক্ষা বা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের বিপক্ষে সরব ছিলেন। রাজনৈতিক ইতিহাস বলে দত্তোপন্থ ঠেংড়ির স্বদেশি জাগরণ মঞ্চকে নিয়ে যেসব আন্দোলন করেছিলেন, অনেক সময় এমনকি বামেদের সঙ্গে নিয়েও, তার জেরেই বাজপেয়ী পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ড সংক্রান্ত অনেক বিধিনিষেধের পরিবর্তন করতে পারেননি।
ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতনে বাজপেয়ী জমানায় যখন দত্তোপন্থ ঠেংড়ি শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে লড়ছেন, তখন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের সভাতে প্রথম দেখা যেত দক্ষিণী এক দম্পতিকে। সেই দম্পতির একজন নির্মলা সীতারামন পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদির জমানায় অর্থমন্ত্রী হয়েছেন, আর তাঁর স্বামী পরাকালা প্রভাকর স্ত্রীর অর্থনীতির কট্টর সমালোচক। পরাকালা প্রভাকর তাঁর লেখায়, তাঁর ভিডিওতে বারবার বর্তমান সরকারের অর্থনীতির কড়া সমালোচনা করে বলেন, গত দশ বছরে আসলে ভারতবর্ষ ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট’-দের হাতে চলে গিয়েছে, সেই অর্থনীতিতে শ্রমিকদের, প্রান্তিক মানুষের কোনও জায়গা নেই।
যদি গোটা দেশের পরিস্থিতিকে খোদ অর্থমন্ত্রীর স্বামী, একসময় আরএসএসের তাত্ত্বিক শ্রমিক নেতা দত্তোপন্থ ঠেংড়ির ছায়াসঙ্গী পরাকালা প্রভাকর এইভাবে ব্যাখ্যা করেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ তার থেকে বাইরে থাকে কী করে? শ্রমিকের অধিকার বা মে দিবস উদযাপন তখন তো সত্যি সত্যি প্রাসঙ্গিকতা হারায় বা নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়।
বর্তমান বিজেপি সরকার অবশ্য মে দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতাতেও বিশ্বাস করে না। বরং ১ মে’র পরিবর্তে তারা বিশ্বকর্মা দিবস এনেছে, যেখানে ধর্মকে যোগ করে দেওয়া যায়। বিজেপি বিরোধীদের অভিযোগ করোনা নামক অতিমারির সময় যেভাবে মোদি সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায়তার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার থেকেই পরিষ্কার যে আসলে শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে কেন্দ্র কতটা চিন্তিত। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বন্ধের বিরুদ্ধে। তাই তাঁর তেরো বছরের শাসনকালে বন্ধ যেমন বিশেষ দেখা যায়নি, তেমনই আগে বামেদের নিয়ম করে প্রতিবছর ডাকা শিল্প ধর্মঘটও উধাও হয়ে গিয়েছে। ২০২১ সালে গোটা দেশে যখন বিজেপি সরকারের নীতির প্রতিবাদে বামপন্থী দলগুলি দু’দিনের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল, তখনও পশ্চিমবঙ্গে সেই নিয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক গবেষকরা মনে করেন, ইউরোপ যখন শ্রমিকদের স্বার্থে বিভিন্ন তীব্র আন্দোলন ডেকেছে, এমনকি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁর পেনশন নীতির প্রতিবাদে তীব্র শ্রমিক বিক্ষোভে ফ্রান্স দু’মাসের জন্য অচল থেকেছে, তখন কিন্তু ভারতবর্ষে শ্রমিকদের অধিকার বা শ্রম আইন পরিবর্তন নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল চোখে পড়েনি।
ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণে আজকের ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গও দাঁড়িয়ে, সেখানেই তাই কারখানার গেটে আর মে দিবস উদযাপন হয় না। ‘অ্যালবার্ট পিন্টো কো কিউ গুসসা আতা হ্যায়’-এর মতো আইকনিক সিনেমার দৃশ্যের অনুকরণে কোনও শ্রমিক নেতার ঝাঁঝালো বক্তৃতাও শোনা যায় না। বড় শিল্পপতিদের দেওয়া চার্টার্ড প্লেনে ঘোরাই যখন রাজনীতিকদের জন্য স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন শ্রমিকের স্বার্থ, প্রান্তিক মানুষের বঞ্চনার হিসেব কীভাবে মাপা যাবে? হয়তো আবার কোনও রাজনৈতিক বিস্ফোরণ বা উলটপুরাণের জন্য ইতিহাসকে অপেক্ষা করতে হবে।
(লেখক সাংবাদিক)
শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী…
শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান…
মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক : নন্দীগ্রাম গণহত্যা নিয়ে ফের বিস্ফোরক মমতা। এবার নাম না করে…
মালদা: নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মালদা জেলা আদালত। এছাড়া…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিচারপতির চেয়ার ছেড়ে জনতার দরবারে হাজির হয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Ganguli)।…
This website uses cookies.