- দীপ সাহা
দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ। তার মাঝে মাঝে এখন মাথা তুলেছে টিনের চালা। কোথাও আবার কংক্রিটের ইমারত স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে। অথচ বছর কুড়ি আগেও সেখানে ফলত ধান। লাঙলের ফলায় উর্বর হয়ে উঠত চাষের জমি। ওই চৌহদ্দিতে এখন অবশ্য চাষবাসের বালাই নেই।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’। মগজাস্ত্রে শান দিয়ে তা দিয়ে সেই বাণীকেই যেন জীবনের বেদবাক্য মেনে নিয়েছেন তৃণমূল নেতা ও জমি মাফিয়ারা। তাই তো আবাদি জমি হোক বা খাসজমি কিংবা নদীর চর, দখল করে বেচে দেওয়াটা যেন অলিখিত প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। সঙ্গে জুটেছে সরকারি দপ্তরের গুটিকয় কর্তা। গোটা রাজ্যে ছবিটা একইরকম হলেও জমি দখলের প্রতিযোগিতা সব থেকে বেশি যেন উত্তরবঙ্গে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাজগঞ্জে ব্লকে। তা বিলক্ষণ জানেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানও। তাই তো ভরা সভায় আর কোনও জায়গার নাম না নিলেও তাঁর মুখে উঠে এসেছিল ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির জমি মাফিয়ারাজের কথা।
গোরু পাচার কাণ্ডে তৃণমূলের পদে থাকাকালীন জেলে গিয়েছিলেন বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল। আর জমি দুর্নীতিতে এই প্রথম কোনও পদাধিকারীকে জেলে ঢোকাল তৃণমূল। দলের ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির ব্লক সভাপতি দেবাশিস প্রামাণিককে গারদে পুরলেও তাঁর মতো আরও কয়েকশো ছোট-বড়-মাঝারি মাপের নেতা বা জমি মাফিয়া এখনও এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে কলার তুলে। এদের কেউ আগে সিপিএমে ছিল, কেউ কংগ্রেসে। তৃণমূলে এসে জমির কারবারে জুড়ে তাদের প্রত্যেকেরই আঙুল ফুলে কলা গাছ। আলিশান বাড়ি, গাড়ি, বিঘার পর বিঘা জমি, মার্কেট কমপ্লেক্স করে ফেলেছে অনেকেই। দেবাশিসের গ্রেপ্তারির পর তাদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে চর্চা চলছে সর্বত্র।
কলকাতার পরই রাজ্যে দ্বিতীয় বর্ধিষ্ণু শহর শিলিগুড়ি। একদিকে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি, আরেকদিকে মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, মূলত এই দু’দিকেই বিস্তৃত হচ্ছে শহর। গত দেড় দশকে শহর ও লাগোয়া এলাকায় জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। সিকিম, অসম, মণিপুরের মতো রাজ্য তো বটেই, এখানে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছেন নেপাল, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশের বাসিন্দারাও। সীমান্ত লাগোয়া এলাকা হওয়ায় অনুপ্রবেশ তো আছেই। ফলে জমির চাহিদা আকাশছোঁয়া। আর সেটা করতে গিয়েই সংগঠিত হতে শুরু করেছে জমি মাফিয়ারা। অলিখিত সিন্ডিকেট তৈরি করে শুরু হয়েছে জমি দখল, চরিত্র বদলের মতো কারবার।
বছর কুড়ি আগেও শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া আশিঘর মোড় পেরোনোর পর চোখে পড়ত ধু-ধু প্রান্তর। নরেশের হাট পেরোনোর পরই শুরু হয়ে যেত বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল। অথচ আজ সেখানে বিশাল বিশাল ইমারত। গোডাউন, ফ্যাক্টরিতে ভরে উঠেছে গোটা এলাকা। ফাড়াবাড়ি, রাজ ফাঁপড়ি, শালুগাড়াতেও একই ছবি। বিক্রি হয়ে গিয়েছে সাহুর চরও। নদীর পাশেই মাথা তুলেছে বসতবাড়ি। রীতিমতো কলোনি বসিয়ে ফেলেছেন তৃণমূল নেতারা। সাহুডাঙ্গি, আমবাড়ির মতো এলাকায় রাস্তার দু’পাশে থাকা খাসজমি, রেলের জমিও দখল হয়ে গিয়েছে অনায়াসে। বাধা দিতে আসেনি কেউ। আর দেবেই বা কে! যারা জমি দখল করেছে তারা তো কোনও না কোনও দলের ছত্রছায়ায়। তাদের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধার লোক কোথায়!
পোড়াঝাড়ে তো তিস্তা ব্যারেজের জমিই বেদখল হয়ে গিয়েছে চোখের সামনে। শুধু মাফিয়া নয়, দপ্তরের কিছু কর্তার যোগসাজশ না থাকলে যে এমনটা সম্ভব নয়, তা বলছেন স্থানীয়রাই। বড়কর্তারাও আসি যাই, মাইনে পাই গোছের মনোভাব নিয়ে আর কাউকে ঘাঁটাতে যাননি। যার পরিণতি এই।
উত্তরবঙ্গে জমি মাফিয়ারাজের শুরুটা বাম আমলেই। তখন অল্পস্বল্প সরকারি জমিতে বাড়িঘর, দোকান বসিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু পকেটে পুরত দালালরা। তার বখরা যেত স্থানীয় নেতাদের হাতেও। কিন্তু কালক্রমে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর সেই চক্রটাই সংগঠিত হতে লাগল। দালালরা ক্রমেই হয়ে উঠতে লাগল জমি মাফিয়া। নজর পড়ল নদীর চর, বনের জমিতেও।
জলপাইগুড়ি জেলার বাকি অংশ, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদাতেও জমি দখলের কারবার আছে। কিন্তু রাজগঞ্জের মতো সংগঠিত চক্র কোথাও নেই। পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে প্রধান, তৃণমূলের পদাধিকারীদের অনেকেই এই জমির কারবারে জড়িয়ে।
তৃণমূল আমলে রাজ্যে শিল্পের করুণ দশা বলে প্রায়শই অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। কিন্তু জমির কারবারকেও যে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা বুঝিয়ে দিয়েছে তৃণমূল নেতাদের একাংশ। ফুলবাড়ির দেবাশিস বিরোধী গোষ্ঠীর এক নেতা সরকারি জমি দখল করে গোটা বাজার তৈরি করে ফেলেছেন। আরেক নেতা বসিয়েছেন গোটা কলোনি। কাওয়াখালি, পোড়াঝাড় থেকে এখনও বছরে কয়েক কোটি টাকা পকেটে ঢুকছে নেতাদের। ‘কর্মসংস্থান’ হয়েছে আরও জনা পঞ্চাশেকের। একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বেচে দেওয়াতেও এরা সিদ্ধহস্ত। ফলে শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে যত না কামানো যায়, তার কয়েকশো গুণ বেশি কামানো যাচ্ছে এই জমির কারবারে।
গোটা বাংলায় সবথেকে বেশি দুর্নীতি হয় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরে। জমি, বালি-পাথর থেকে মাসে কয়েকশো কোটি টাকা ওঠে। সেই টাকার ভাগ যায় কলকাতাতেও। উত্তরবঙ্গের তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা আমাদেরই এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘কলকাতা থেকে টার্গেট বেঁধে দেওয়া আছে। আরে মশাই, বালি-পাথর, জমি থেকে টাকা না তুললে অত টাকা পাঠাব কীভাবে!’ উত্তরবঙ্গে এক জেলার শীর্ষ নেত্রীর স্বামীও এখন জমির কারবার করে মোটা টাকা কামাচ্ছেন। সেই টাকারও নাকি ভাগ যাচ্ছে রাজ্যের শীর্ষ নেতার কাছে।
ছোটবেলায় বইয়ে আমরা বাস্তুতন্ত্র পড়েছি। এই জমির কারবারও ঠিক বাস্তুতন্ত্রের মতো। একেবারে স্থানীয় স্তরের দালাল থেকে শুরু করে মাফিয়া, অঞ্চল স্তরের নেতা, ব্লক স্তরের নেতা, জেলা স্তরের নেতা, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের কর্মী-আধিকারিক, রাজ্যের নেতা সকলেই হিস্যা পায় এখান থেকে।
সাধারণ মানুষ আগে মিউচুয়াল ফান্ডের চাইতেও বেশি বিনিয়োগ করতেন জমিতে। যাঁদের একটু সামর্থ্য ছিল, তাঁরা অল্পস্বল্প জমি কিনে রাখতেন। কেউ হয়তো মেয়ের বিয়ের কথা ভেবে, কেউ আবার দুঃসময়ের জন্য। কিন্তু এই করতে গিয়ে কত মানুষ যে চোখের জল ফেলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কুড়ি, তিরিশ বছর আগে কেনা জমির হুবহু দলিল তৈরি হয়ে গিয়েছে অন্যের নামে। ভূমি দপ্তরের যোগসাজশ না থাকলে যে এ কাজ সম্ভব নয়, তা একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দিতে পারবে।
আশিঘর এলাকার এক বৃদ্ধার ১০ কাঠা জমি ছিল জলেশ্বরীতে। নকল নথি বানিয়ে সেই জমি দখল করে নিয়েছিল মাফিয়ারা। বৃদ্ধা প্রতিবেশীর সহায়তায় কাগজপত্র নিয়ে ছুটেছিলেন রাজগঞ্জে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরে। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু- এই করতে করতে বৃদ্ধার চটি ক্ষয়ে গিয়েছে, কিন্তু সুরাহা হয়নি। শেষমেশ এক তৃণমূল নেতার মধ্যস্থতায় ৫ লক্ষ টাকায় রফা করার প্রস্তাব দেওয়া হয় বৃদ্ধাকে। স্বামীহারা বৃদ্ধা বাধ্য হন ৫ লাখ টাকা নিয়ে জমিটি ছেড়ে দিতে। অথচ ওই সময় জমিটির দাম ছিল কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা।
এমন উদাহরণ ভূরিভূরি। কেউ জমি হারিয়ে চোখের জল ফেলেছেন, কেউ অভিশাপ দিয়েছেন মাফিয়াদের। কিন্তু জমি ফিরে পাননি। সেই জমিই হয়তো পরে হাতবদল হয়ে গিয়েছে অন্য কারও হাতে। মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর তাঁদের অনেকেই মনে জোর পেয়েছেন। শয়তানদের শাস্তি হবে বলে আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু সত্যিই কি তাঁদের চোখের জলের মূল্য চোকাতে পারবে সরকার, নাকি দু’দিন পর আবার সব থিতু হয়ে গেলে অন্য কোনও মায়ের জমি কেড়ে নিতে উদ্যত হবে শয়তানরা!