- চিরদীপা বিশ্বাস
রাত প্রায় এগারোটা, হস্টেলের রুমে আলোচনায় নিমগ্ন তিনটি ছেলে। বয়স তাদের একুশ-বাইশের এপাশ-ওপাশ। আলোচনার বিষয়বস্তু ফুটবল, ক্রিকেট বা রাজনীতি নিয়ে শুরু হলেও শেষে গিয়ে থামে ‘ভবিষ্যতে’।
কেন তারা পড়াশোনা করছে, শেষে গিয়ে এর ফলই বা কী হবে, আদৌ চাকরি-বাকরি জুটবে তো, তাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে কী কী বদল করত- এরকম প্রশ্ন প্রতিদিন তারা প্রায় একবার ঝালিয়ে নেয়। তারা জানে এই মুহূর্তে এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর নেই, তবুও অভ্যাসের দাস তারা।
হঠাৎই তাদের একজন হয়তো ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের কোনও ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে দু’-চারটে মোটিভেশনাল স্পিচ দেয়। তারপর চিরাচরিত নিয়মে ‘ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন’ বলে বাস্তব থেকে অনেক দূরে স্বপ্নের জগতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়।
এই বাস্তবতাকে গল্প ভেবে কেউ ভুল করবেন না। আজকাল দেশে যুবসমাজের অধিকাংশের এটাই রুটিন। ঘুম ভাঙা থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত একইভাবে যন্ত্রের মতো তারা দৌড়ে চলেছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে। পরীক্ষার পর শুনছে পরীক্ষা বাতিল, রিটেস্ট নেওয়া হবে। কিংবা নিটের মতো উচ্চমানের পরীক্ষার রেজাল্টের দিন দেখছে গ্রেস মার্কসের ছড়াছড়ি। শুধু তাই নয়, চাকরি পাওয়ার পরও যে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না, তার শিক্ষাও পেয়ে যাচ্ছে নিয়োগ দুর্নীতির দৌলতে।
নানা কথা উঠছে। দেশের মেরুদণ্ডে আস্তে আস্তে ঘুণ লাগছে, সেটা কি রাষ্ট্র বুঝতে পারছে না! নাকি তারা চাইছেই মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ুক কারণ, ছাত্ররা ‘যত বেশি জানে তত কম মানে।’ নিয়োগ দুর্নীতি, প্রায় প্রত্যেক রাজ্যে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁস, সর্বভারতীয় পরীক্ষায় দুর্নীতি সবকিছুই যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনাতে পরিণত হয়েছে এখন। এত কিছুর পরও তাই আমাদের ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। ‘কী আর করা যাবে মেনে নিতে হবে’ই যেন একমাত্র আপ্তবাক্য।
এসবের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মও। ‘পড়াশোনা করে কী করব’ ধরনের মানসিকতায় ইন্ধন জোগানোর জন্য এই স্ক্যামগুলি যেন ব্রহ্মাস্ত্র। ক্লাস নাইন, টেনে পড়া একটা ছেলে বা মেয়ে যদি চোখের সামনে এসব দেখতে দেখতে বড় হয়, তাদের মানসিকতায় নঞর্থক বদল আসাটা অস্বাভাবিক ঘটনা তো নয়। এরপর অ্যাকাডেমিক্স বা উচ্চশিক্ষার পথ না বেছে কেউ যদি সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে, অভিভাবকেরাও হয়তো দৃঢ়তার সঙ্গে না বলার আগে দু’বার ভাববেন এখন।
বর্তমান দুনিয়ায় স্বাবলম্বী হওয়াটা ভীষণ জরুরি। শুধু ভগবান আর ভাগ্যের দোহাই দিয়ে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি গ্রহণ করলে, অবসাদগ্রস্ত মস্তিষ্ক অন্ধকার ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছুই দেখাবে না। তাই নিজের আয়ত্তে থাকা সবটুকু দিয়ে ‘আউট অফ দ্য বক্স’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিকতা ধীরে ধীরে তৈরি করতে হবে, যাতে পরিস্থিতি ভগবানের ভরসায় নয় নিজের দক্ষতায় সামলে নেওয়ার মতো ক্ষমতা তৈরি হয়।
(লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কোচবিহারের বাসিন্দা)