প্রতীকী ছবি
গল্পটা মালবাজারের একটি স্কুলের। বছর দশেকের এক ছাত্রকে বাবা-মা নিয়ে এলেন এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। দিনের পর দিন স্কুলে যেতে চায় না বাচ্চাটি। বাড়িতেও মন খারাপ করে বসে থাকে। বন্ধুরা তাকে নাকি একঘরে করে দিয়েছে। কারণ তার গায়ের রং কালো। তার ভাষাও নাকি বন্ধুদের সঙ্গে ঠিক মেলে না। তাই তার সঙ্গে টিফিনের ভাগ হয় না, খেলার সময় বন্ধুদের কোনও টিমেই সে ডাক পায় না।
নামী ওই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চমকে উঠেছিলেন। ব্ল্যাক ট্রাইব-হোয়াইট ট্রাইবের যে সুপ্ত সংঘাত সমাজে রয়েছে, তা শিশুমনে কী ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছে, সেটা দেখে। দীর্ঘ চিকিৎসাতেও শিশুটি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কারণ তার বন্ধুরা তাকে মেনে নেয়নি।
এই একঘরে করে দিয়ে তার উপর অত্যাচার- এই মানসিক প্রবৃত্তি কিন্তু সমাজের নতুন কোনও অসুখ নয়। মধ্যযুগ থেকে পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যে এমন ঘটনার ভূরিভূরি উদাহরণ আছে। আমাদের আদিবাসী সমাজে ডাইন বা ডাইনি চিহ্নিত করার সঙ্গে উইচ হান্টিংয়ের কোনও তফাত নেই। আবার ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির মানসিকতাও এই একসুরে মিলে যায়। কখনও দু’একজন তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাকিদের উসকে দেয়। কখনও ওই শিশুটির মতোই নির্দিষ্ট ব্যক্তির কোনও আচরণ বাকিদের সঙ্গে মেলে না বলে বাকিরা তাকে ‘সফট টার্গেট’ হিসাবে বেছে নেয়।
চোপড়া থেকে ফুলবাড়ি, উত্তরবঙ্গ এখন উত্তাল গণপিটুনি নিয়ে। দক্ষিণবঙ্গে, একেবারে খোদ কলকাতাতেও গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে। কখনও পরকীয়া সম্পর্কের দোহাই দিয়ে, কখনও চোর বা ডাইনি অপবাদ দিয়ে সালিশি সভার নামে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে কাউকে। তাতে হতভাগ্যের মৃত্যু হলেও উন্মত্ত জনতার কিছু যায়-আসে না।
সবচেয়ে অবাক করার মতো ঘটনা হল, এই জনতার মধ্যে দু’একজনের ক্রিমিন্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলেও সকলের তা থাকে না। প্রশ্ন ওঠে তাহলে তারা কেন জড়িয়ে পড়ছে এমন ঘৃণ্য কাজে?
মনোবিদরা বলছেন, স্তন্যপায়ীদের মধ্যে যারা নিম্ন প্রবৃত্তির (লোয়ার ম্যামলস) তাদের মধ্যে এই দলবদ্ধভাবে কাউকে আক্রমণ করার মানসিকতা বেশি। বাঘ-সিংহ থেকে মানুষ সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। তাদের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে দুর্বল কাউকে বা অন্য গোষ্ঠীর কাউকে বেছে নিয়ে দু’-একজন হামলা শুরু করে। তারপর তাতে যোগ দেয় বাকিরা। যে কোনও গণপিটুনির পিছনে এই গ্রুপ ডায়ানামিক্স বা গোষ্ঠী সমীকরণ কাজ করে।
উত্তরবঙ্গের দিকে ফিরে তাকালে দেখব গণপিটুনি এবং অনেক ক্ষেত্রেই হতভাগ্যকে খুনের ঘটনার উদাহরণ ভূরিভূরি আছে। গৌড়বঙ্গ তো এমন ঘটনার জন্য কুখ্যাত। গতবছর সেপ্টেম্বরে পুরাতন মালদায় বাড়ি ভাড়া নিতে আসা এক দম্পতিকে চোর সন্দেহে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে পেটানো হয়। ওই এলাকায় কয়েকটি বাড়িতে পরপর চুরি হওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসীর আক্রোশ গিয়ে পড়ে ওই দম্পতির উপর। অথচ, ওই দম্পতির কাছ থেকে চোরাই সামগ্রী কিছু পাওয়া যায়নি। এর কিছুদিন আগে ওই এলাকাতেই মোবাইল চোর সন্দেহে এক তরুণকে বেঁধে পেটানো হয়েছিল।
এবছর তো ছেলেধরা গুজবকে কেন্দ্র করে মালদা থেকে কোচবিহারে পরপর গণপিটুনির ঘটনা ঘটে যায়। কোথাও ফেরিওয়ালা, কোথাও বাইরে থেকে কোনও প্রয়োজনে এলাকায় আসা কোনও ব্যক্তি, কোথাও মানসিক ভারসাম্যহীন কেউ এর শিকার। গতবছর অগাস্টে পুণ্ডিবাড়ির বাহান্নঘর এলাকার একটি ঘটনা তো হাড়হিম করে দেয়। ওই সময় এলাকায় ছেলেধরা ঘুরছে বলে রটনা ছিল। দলগাঁও ও নাগরাকাটার হিন্দিভাষী দুই ব্যক্তি অমরনাথ এক্সপ্রেসে ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে যাচ্ছিলেন। রাতের দিকে পুণ্ডিবাড়ি স্টেশনে কোনও কারণে ট্রেন দাঁড়ানোয় তাঁরা জলের খোঁজে নেমেছিলেন। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় তাঁরা আর উঠতে পারেননি। স্টেশনের বাইরে বেরোতেই তাঁদের ঘিরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। ভাষাগত সমস্যার জন্য তাঁদের বক্তব্য স্থানীয়রা ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। সিদ্ধান্ত হয়, ওই দুজন ছেলেধরা। অমানুষিক মারধর করা হয় দুজনকে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে। এর পরদিনই ওই একই এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীনকে একই অপবাদে পেটানো হয়। অথচ, ওই এলাকায় কারও সন্তান চুরি হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
তাহলে এমন মানসিকতার সূত্র কোথায়? দেখা যাচ্ছে, গত সেপ্টেম্বরে তুফানগঞ্জের অন্দরান-ফুলবাড়ি এলাকার পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিযোগ, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একজন তাকে চকোলেট দিয়ে গাড়িতে উঠতে বলে। সে জলের বোতল ছুড়ে পালিয়ে আসে। এরপর থেকেই তুফানগঞ্জে ছেলেধরা ঘুরছে বলে গুজব রটে যায়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যায় যে ওই বছর পুজোর আগে ভিনরাজ্য থেকে গ্রামে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালারাও আতঙ্কে আর গ্রামে যেতে পারেননি। তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে এই ছেলেধরার গুজব বারবার ফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গে। ২০১৮ সালে জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন বালাপাড়ায় এসে পড়েন হলদিবাড়ির এক তরুণ। রাস্তা ভুল করায় পাটখেতে চলে যান তিনি। তাঁকে ছোটাছুটি করতে দেখে এলাকার বাচ্চারা আতঙ্কে বাড়িতে জানায়। এলাকায় রটে যায় ছেলেধরা এসেছে। তাঁকেও বেধড়ক পেটানো হয়।
সম্প্রতি তিনটি ঘটনা উত্তরবঙ্গকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে চোপড়ার ঘটনা তো রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় ইস্যু হয়ে উঠেছে। পরকীয়া সম্পর্কের অভিযোগে রাস্তায় ফেলে যুগলকে নৃশংসভাবে মারধর করেন তৃণমূলের এক নেতা ও তাঁর সঙ্গীরা। কয়েকশো মানুষ দাঁড়িয়ে দেখেন সেই ঘটনা। একজনের মুখেও প্রতিবাদ শোনা যায়নি। দ্বিতীয় ঘটনাও প্রায় এর প্রতিচ্ছবি। শিলিগুড়ির কাছে ফুলবাড়িতে এক গৃহবধূ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। সালিশি সভা বসিয়ে ওই তরুণীকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর স্বামী ও ভাইয়ের সামনেই তরুণীকে মারধর শুরু করেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী ও তাঁর সঙ্গীরা। অপমানে বাড়ি ফিরে বিষ খান ওই তরুণী। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রায় একই সময়ে ফাঁসিদেওয়ার চটহাটে স্বামীর মৃত্যুতে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারধর করার অভিযোগ ওঠে শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অভীক লস্কর মনে করেন, গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ এমন কিছু করছেন, যা প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মিলছে না। সুতরাং তিনি স্থানীয় সমাজকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাচ্ছেন, এমন মানসিকতা থেকে অত্যাচারের ঘটনা ঘটে যায়। আবার কখনও গোষ্ঠীর বাইরে থেকে আসা কোনও মানুষ সফট টার্গেট হয়ে যান। তবে, সবক্ষেত্রেই একটা বিষয় পরিষ্কার। যাঁরা হামলা করেন, তাঁরা কোনও না কোনওভাবে প্রশাসনিক শাসনের শিথিলতার সুযোগ নেন। সেটা রাজনৈতিক বা আর্থিক যে কোনওদিক থেকেই হতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমল রায় খুব পরিষ্কারভাবেই বলছেন, যে অপরাধগুলি ঘটছে তা মূলত মেয়েদের উপর। তার পিছনে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা বড় প্রভাব রয়েছে। মেয়েদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটা ধারণা আমাদের সমাজের শিকড় গেড়ে রয়েছে। পুরুষের সঙ্গে তাঁদের সামাজিক অবস্থানেও ভেদ রয়েছে। এই ভেদাভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনও মহিলা ভিন্ন কোনও অবস্থান নিলেই তিনি সমাজের ‘মাথা’ হিসাবে পরিচিত পুরুষদের রোষে পড়েন। অল্পশিক্ষিত বা শহরের বাইরে মফসসল বা গ্রামীণ এলাকায় এই ধরনের ‘মাথাদের’ নিয়ন্ত্রণ প্রবল এবং এমন ‘মাথা’ খুঁজে পাওয়া যাবে না যাঁর কোনও শক্তপোক্ত রাজনৈতিক আশ্রয় নেই। তার জোরেই তিনি আইন ভাঙছেন জেনেও সালিশি সভা ডাকা বা প্রকাশ্যে নগ্ন করে মারধরের সাহস পান। এই বাহুবলী মাথা ভালো করেই জানেন, তিনি একবার এ ধরনের কাজ করতে পারলে এলাকায় তাঁর দাপট অগ্রাহ্য করার বা তাঁর নিদানের প্রতিবাদ করার ‘ধৃষ্টতা’ থাকবে না কারও। যাঁরা হামলা করছেন তাঁরা রাজনৈতিক ও আর্থিক দিক থেকে অনেক বলীয়ান। বাকি সমাজ অন্যায় বুঝেও নীরব দর্শকমাত্র।
রাজ্যে ৫ বছর ধরে পড়ে থাকা গণপ্রহার বিরোধী বিল বা ন্যায় সংহিতার নতুন ধারায় গণপ্রহারে মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হয়তো এমন ঘটনায় দোষীদের কড়া শাস্তি দেবে। কিন্তু এতবড় সামাজিক ব্যাধি সারাতে পারবে কি না সন্দেহ। তার জন্য সমাজের মানসিকতার বদল প্রয়োজন। প্রকৃত শিক্ষা প্রয়োজন।
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বাঙালির খাবারের প্রতি টান অদম্য। আর তাতে যদি হয় চপ, সিঙারা…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: জেলবন্দি অবস্থাতেই আরও বিপাকে পড়লেন আপ নেতা তথা দিল্লির প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী…
অভিজিৎ ঘোষ, আলিপুরদুয়ার: অবশেষে আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে (Alipurduar Hospital) শুরু হতে চলেছে হাইব্রিড সিসিইউ (Hybrid…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রথের দিন জিলিপি খাবে না, এরম বাঙালি বোধহয় খুব কমই আছে।…
মোস্তাক মোরশেদ হোসেন, রাঙ্গালিবাজনা: আলিপুরদুয়ারের (Alipurduar) মাদারিহাট-বীরপাড়া ব্লকের খয়েরবাড়ি ও রাঙ্গালিবাজনায় একের পর এক মহল্লা…
মণীন্দ্রনারায়ণ সিংহ, আলিপুরদুয়ার: কোথাও কোমর, কোথাও বুকসমান জল (Flood Like Situation)। শোয়ার ঘর থেকে রান্নাঘর…
This website uses cookies.