উত্তর সম্পাদকীয়

ব্যক্তি মোদির বিবর্তন ও উত্তরণ

  • জয়ন্ত ঘোষাল

নরেন্দ্র মোদিকে ঠিক কবে প্রথম সামনাসামনি দেখেছিলাম, কবে কথা হয়েছিল আজ এত বছর পর সুনির্দিষ্টভাবে সেটা মনে নেই। তবে এটা মনে আছে অশোক রোডে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পিছনে বেশ কিছু ব্যারাক ঘর ছিল। সেখানে আরএসএসের প্রচারক দলের একনিষ্ঠ কর্মীরা থাকতেন। অনেকটা ব্রহ্মচর্যাশ্রমের মতোই। সেখানে একটা ঘরে থাকতেন গোবিন্দাচার্য, আরেকটা ঘরে থাকতেন মোদি।

১১ নম্বর অশোক রোডের সেই বাড়িতে প্রতিদিন বিকেল তিনটের সময় যেতাম। কেননা ওই সময়টাতেই দলের মুখপাত্রদের সঙ্গে সাংবাদিকদের গল্পগুজব কথাবার্তা এসব হত। তখনও এত সংঘটিত ডেইলি ব্রিফিং ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু চারটার সময় ২৪ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেস ভবনে সাংবাদিকরা যেতেন। আর সেই কারণেই বিজেপি বলেছিল, তিনটের সময় আসতে। যাতে ওভারল্যাপিং না হয়। আমার মতো বহু সাংবাদিক অফিসেই যেতেন।

মোদি আড্ডা মারতেন, গল্প করতেন। লালকৃষ্ণ আদবানি যখন দলের সভাপতি হন, তখন মোদি ছিলেন তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ। আদবানি একটা নূতন প্রজন্মের নেতাদের টিম তৈরি করে ফেললেন। কেন্দ্রে সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিং, অরুণ জেটলি, প্রমোদ মহাজন, অনন্ত কুমার কত নাম বলব? পরে এলেন নীতিন জয়রাম গড়করি, গোপীনাথ পান্ডুরং মুন্ডে, ভেঙ্কাইয়া নাইডু। কিন্তু এঁদের মধ্যে মোদি ছিলেন সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কারণ তিনি কখনোই একদম সামনে এসে খুব বেশি হইচই করার মতো কাণ্ডকারখানা তখন করতেন না। গুজরাটেরও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন অনেক পরে।

কেশুভাই প্যাটেল গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী শুধু নন, আরএসএসেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে মোদি দলের অনাবাসী ভারতীয়দের সংগঠন এবং বিদেশের দলের কার্যকলাপের সঙ্গেও বহু বছর যুক্ত ছিলেন। বহু গুজরাটি আসলে আমেরিকা, ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। মোদি বিদেশেও অনেক কাজ করেছেন।

আজকে যে তিনি বিদেশনীতি নিয়ে এত সক্রিয় এবং অনেক সাফল্য অর্জন করছে ভারতীয় বিদেশনীতি, তারও একটা ইতিহাস আছে। উনি কিন্তু বহু বছর ধরে ভারতের বিদেশনীতির উপরে বিজেপির মতাদর্শের ভিত্তিতে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েছেন। বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী,বাজপেয়ীর সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছি। সেখানে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভার বৈঠক। পাশাপাশি ওখানকার অনাবাসী ভারতীয় গুজরাটিদের সম্মেলন হবে। সেই সম্মেলনে বাজপেয়ী গিয়েছেন। সেখানে মোদি, বাজপেয়ী আসার আগে থেকে সেই সমস্ত অনাবাসী ভারতীয়দের সংগঠিত করতেন। যা আজকে বিদেশে বিজেপি সংগঠন করে। বাজপেয়ী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত লোককে জড়ো করলে কী করে। কতদিন সময় লেগেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়াও তো একদিনের ব্যাপার নয়। কেশুভাই প্যাটেলের বিরুদ্ধে এমএলএদের অসন্তোষ তৈরি হল ধীরে ধীরে। তারপর কেশুভাইকে সরিয়ে মোদি মুখ্যমন্ত্রী হলেন। সেটা সম্ভব হয়েছিল আদবানির জন্য। আদবানি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। যদিও বাজপেয়ীর প্রথম থেকেই সেটা নিয়ে একটুখানি আপত্তি ছিল। কারণ কেশুভাইকে সমর্থন করছিলেন।

এখনও মনে আছে যখন গোধরা কাণ্ড হল, তখন চন্দ্রবাবু নাইডু আওয়াজ তুললেন যে এখনই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে সরাতে হবে। বেঙ্গালুরুতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক। রটেছিল, সেদিনই বিকেলবেলায় মোদিকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কেশুভাই হুইলচেয়ারে এসেছিলেন। সকালবেলায় বৈঠক বসার আগে আদবানিকে ফোন করলাম তাঁর ঘরে। তিনি অফ দ্য রেকর্ড সেদিন বলেছিলেন, ‘মোদিকে সরানো হবে না। চন্দ্রবাবু আজ সকালবেলা দাবি তুলেছেন এটা টিভিতে দেখেছি। কিন্তু শরিক দলের দাবিতে বিজেপি তার মুখ্যমন্ত্রী সরাবে না। আজ বিকেল তিনটেয় জনা কৃষ্ণমূর্তি সাংবাদিক বৈঠক করে তোমাদের সেসব কথা জানিয়ে দেবেন।’

বিকেল তিনটের সময় সাংবাদিক বৈঠক হয়েছিল এবং মোদি থেকে গেছিলেন। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, আদবানি কী সাংঘাতিকভাবে মোদিকে সমর্থন করেছিলেন। তখন মোদি ক্রমশ নিজেকে আরও গড়ে তুলেছেন। আজ যে মোদিকে দেখি, প্রতিটা মুহূর্তে যেন তিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একবার আমি ওঁকে বলেছিলাম, আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, আশা করি অনেক খবর পাব। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন কীরকম খবর? আমি বললাম, যেমন মন্ত্রীসভার রদবদল। মোদি খুব হাসলেন এবং তারপরে বললেন, ‘আমি ওইরকম নেতা নই যে ক্যাবিনেট হওয়ার আগে বলে দেব, কে মন্ত্রী হচ্ছেন আর কে হচ্ছেন না।’ তবে খবর তো সব কিছুই। মোদি কী রঙের পাগড়ি পরে যাবেন ১৫ অগাস্ট লালকেল্লায়? এটা সম্ভব হয়েছে তার কারণ তিনি নিজে কৌতূহল তৈরি করেছেন। একটা স্বরচিত দূরত্বও রচনা করেছেন। আবার একটা নিজস্ব বৃত্তও আছে। তিনি জানেন যে তিনি গেরুয়া রঙের পাগড়ি না পরে যদি ধূসর রঙের পাগড়ি পরে যান, তাহলে এই ব্যাখ্যা হতে পারে, হিন্দুত্ব থেকে কি ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি চাইছেন মোদি।

ওঁকে নিয়ে এই ভাবনাচিন্তাগুলো মোদি খুব উপভোগ করেন। অযোধ্যায় রামলালার মন্দির স্থাপনায় ওঁর যে ভূমিকা টিভি-ক্যামেরার সামনে, তিনি যেভাবে গোটা জিনিসটাকে তুলে ধরলেন, তা দারুণ। ২০২৪ সালে আধুনিক প্রযুক্তি,আধুনিক মিডিয়ার সাহায্যে ধারণা তৈরির রাজনৈতিক রণকৌশলে মোদির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবেন না। তিনি তার প্রতিপক্ষকে দশ গোল দেবেন। তিনি গত দশ বছর ধরে একটা হিন্দুত্বের আখ্যান তৈরি করেছেন। আবার এই মোদি আবু ধাবিতে গিয়ে হিন্দু মন্দির স্থাপন করছেন, উদ্বোধন করছেন। আবার সেই মুসলিম শাসককে তিনি তাঁর ভাই বলে সম্বোধন করছেন। শরিক নেতা নবীন পট্টনায়েককে তাঁর বন্ধু বলে সম্বোধন করছেন। আবার তিনিই কিন্তু প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েন না।

এই মোদি কিন্তু একদিনে তৈরি হয়েছেন এমন নয়। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবেন, গবেষণা করেন। তাঁর রিসার্চ টিম আছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা তাঁকে লোকে একনায়কতন্ত্রী বলতে পারে বটে, তিনি কিন্তু অন্যের মতামত শোনেন। তাঁর পারিষদের মধ্যে যাঁরা তাঁর তোষামোদকারী তাঁদের তিনি পছন্দ করেন না। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে  ব্রিফ করার লোক আছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান। একধরনের মতের কথা তিনি যে শোনেন তা নয়। তিনি খুব ভালো শ্রোতা। বিদেশেও বহু লোক ওঁর সঙ্গে প্রথম দেখা করে বিস্মিত হয়েছেন, কী মনোযোগ দিয়ে তিনি কথা শোনেন তা বলার নয়।

আমার একবার মনে আছে,আমি যখন ওঁর সঙ্গে কথা বলছি, তখন তিনি কখনও ওঁর ঘড়ির দিকে তাকান না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কথা বললে, সাক্ষাৎপ্রার্থীর মনে হয় তাঁকে বোধহয় উঠতে বলা হচ্ছে।  মোদি কখনও সেটা করেন না। বড়জোর একজন সহকারী এসে বলেছেন যে, এবারে তো উঠতে হবে। কেননা অনেক লোক অপেক্ষা করছে। আমি একবার ‘সরি সরি’ বলে উঠে পড়েছি, তখন তিনি আমাকে বলেছেন, ‘আর কোনও প্রশ্ন বাকি থেকে গেল না তো? ওই যে একটা খবরের কাগজের মাথায় কীসব প্রশ্ন খসখস করে লিখে এনেছিলে। দেখে নাও একবার, চেক করে নাও। তারপর বাইরে বেরিয়ে যদি মনে হয় এই প্রশ্নটা করা হল না। তখন তোমারই কাজে অসুবিধা হবে।’

মোদির এই ব্যাপারটা দেশে খুব কম নেতার মধ্যে দেখেছি।

( লেখক সাংবাদিক )

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Hardik Pandya Banned | মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে দুঃসংবাদ! পরের আইপিএলে দলের প্রথম ম্যাচে নির্বাসিত হার্দিক

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: একে তো ঘরের মাঠে লখনউ সুপার জায়ান্টসের (Lucknow Super Giants) কাছে…

32 mins ago

Bus Accident | চাকুলিয়ায় বাস দুর্ঘটনায় মৃত ২, আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩

কানকি: মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় (Bus Accident) মৃত্যু হল ২ জনের। আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩…

1 hour ago

Bus catches fire | যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে আগুন, পুড়ে মৃত্যু ৮ জনের, আহত বেশ কয়েকজন

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: যাত্রীবোঝাই চলন্ত বাসে আগুন (Bus catches fire) লেগে মৃত্যু হল ৮…

1 hour ago

West bengal weather update | রাজ্যের সাত জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতা, জেনে নিন বিস্তারিত…

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মাঝে ক’দিন স্বস্তির বৃষ্টি হয়েছে বঙ্গে। ফলে তীব্র গরম থেকে কিছুটা…

2 hours ago

NBMC | দালাল ধরে টাকা দিতেই হাতে এল মৃত্যুর শংসাপত্র! তদন্তের আশ্বাস মেডিকেল সুপারের

শিলিগুড়িঃ মৃত্যুর শংসাপত্র পেতে ১৫০০ টাকা দিতে হল উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। যে পরিবার…

11 hours ago

Toy Train Joy Ride | ভিড় সামলাতে অতিরিক্ত জয়রাইড ট্রেন চলবে দার্জিলিংয়ে, সিদ্ধান্ত ডিএইচআরের

দার্জিলিংঃ পর্যটকদের অতিরিক্ত ভিড় সামাল দিতে শনিবার থেকে বাড়তি দুটি জয়রাইড টয়ট্রেন চালাবে দার্জিলিং হিমালয়ান…

11 hours ago

This website uses cookies.