নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
ভারত এমন এক আন্তরিক দেশ যেখানে পাশ্চাত্য এসক্যাটোলজির ধ্যানধারণা মেলে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রয়াত হলেও মানসী ভাবনায় তাঁদের সঙ্গে আমাদের বিচিত্র সম্পর্ক সেতু তৈরি হয়। প্রয়াত হওয়ার পরেও তাঁদের অন্নপান যাতে ঠিকমতো চলে, তার জন্য জীবিত জনের দুশ্চিন্তা কম থাকে না। সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য দেবলোকের তলায় তলায় একটা পিতৃলোকের ব্যবস্থা করেছেন শাস্ত্রকারেরা এবং সেই পিতারাও বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন। এই পিতৃলোকেই প্রয়াত মাতা-মাতামহরাও থাকেন। একজন পুরুষ বা স্ত্রীলোককে কখনও একটা গোটা মানুষ ভাবেননি আমাদের শাস্ত্রকারেরা। বৃহদারণ্যক উপনিষদের মতো প্রাচীন উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্যের মতো বহুমান্য ঋষি বলেছেন, একজন পুরুষের শরীর হল অর্ধাংশশূন্য শস্যবীজের- দ্বিদল ডালের অর্ধেক দানার মতো। যে অর্ধাংশ ফাঁকা সেখানে স্ত্রী শরীর এলে তবেই না একটা গোটা মানুষ হয়- তস্মাদিদম অর্ধবৃগলমিব স্ব ইতি সু স্মাহ যাজ্ঞবল্ক্যঃ, তস্মাদয়মাকাশঃ স্ত্রিযা পূযর্যতে এব- এই অর্ধেক আকাশ পূরণ করে স্ত্রীলোক- দুইয়ে মিলে তবে একটা মানুষ।
এই ভাবনা থেকে পিতা এবং মাতাকে সংস্কৃতে একসঙ্গে দ্বিবচনে পিতরৌ বলা হয়, ফলে প্রয়াত মানুষের আবাসিকটাকে খনিক পিতৃতান্ত্রিকতাতেই হয়তো পিতৃলোক বলা হয়েছে এবং সেই পিতৃলোকের কিন্তু একটা অলৌকিক পরিকল্পনা আছে। ধারণা করা হয় যে, জীবিত জনের তিন প্রয়াত পুরুষদের তিনটি জেনারেশন এই পিতৃলোকে থাকেন। তাঁদের আগের সব জেনারেশনকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেন যমরাজ। কারণ, পিতৃলোকের দেখভালের ব্যবস্থা যমরাজের হাতে। পিতৃলোকের এই তিন পুরুষের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা চমৎকার। পিতামাতার উদ্দেশে আমরা যে পিণ্ডদান করি তাতেই তাঁদের খাওয়া চলে। খেয়াল করে দেখুন, সদ্য প্রয়াত মা-বাবার উদ্দেশে আমরা যে শ্রাদ্ধ করি, তার এক বছর হল সপিণ্ডকরণ। আমাদের এক বছর পিতৃলোকের এক দিন- অর্থাৎ বার্ষিক সপিণ্ডকরণের দিন তাঁর অন্ন-পান দিলাম আমরা। এইভাবে প্রতিটি বার্ষিক শ্রাদ্ধে এই একদিনের অন্ন-পান চালিয়ে গেলে মা-বাবা পরম সুখে আশীর্বাদ করতে থাকেন। তার মধ্যে বাড়তি খাবারও জুটে যায়– অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহের নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ ইত্যাদি।
এই সমস্ত প্রকার শ্রাদ্ধগুলিতে পিতা-মাতা সহ পূর্ববর্তী তিন পুরুষকেই শ্রাদ্ধপিণ্ড দান করতে হয়, দিতে হয় জল। তাহলে এই যুক্তিটাই সার্থক হল যে, পূর্ববর্তী তিন পুরুষই পিতৃলোকে থাকেন যাঁদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন সুশাসক যমরাজ, যদিও এই খাওয়াদাওয়ার স্পনসরশিপ প্রয়াত বংশপুরুষদের উত্তরাধিকারী জীবিত বংশধরদের হাতেই। ফলত, এই যে পিতৃলোকের শ্রাদ্ধতর্পণ সেটার অন্তিম স্থান হল মহালয়া– যার সঙ্গে চোদ্দোটি পিতৃপক্ষের দিন জুড়ে আছে। এই সময়ে প্রয়াত পিতৃগণ এবং মাতৃগণ মর্ত্যভূমির সবচেয়ে কাছে আসেন। হয়তো-বা বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থায় বংশধরদের ঘরের মধ্যেই প্রায় চলে আসেন– সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নির্দেশেই নাকি সসৃষ্ট বংশধরদের এইভাবে করুণা করেন তাঁরা।
মহালয়া তিথির এই তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্য তার আগের চোদ্দোদিনের মধ্যেও অনুসৃত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটা কৌতুকপ্রদ কাহিনী না বললেই নয়। কথিত আছে– মহাভারত মহাকাব্যের বিখ্যাত চরিত্র কর্ণ, যিনি দানের সময় কাউকে ফেরাতেন না বলে দানবীর কর্ণ নামে খ্যাত হয়েছেন। সেই কর্ণ যুদ্ধকালে অর্জুনের হাতে মৃত্যুবরণ করার পর বীরের সদ্গতি লাভ করে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে তাঁকে সাভিনন্দনে বরণ করে নিলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। মতান্তরে যম। অভিনন্দন-আবাহনের পর্ব শেষ হলে কর্ণকে খেতে দেওয়া হল থালা সাজিয়ে কিন্তু সে থালায় খাদ্য হল সোনার তৈরি নানা অলংকার, হিরে-মোতি, চুনি-পান্না। কর্ণ এই অদ্ভুত বিপ্রতিপত্তি দেখে দেবরাজের কাছে জিজ্ঞাসু হতেই তিনি বললেন– দ্যাখো বাছা! তুমি এতদিন যত দান দিয়েছ ব্রাহ্মণদের, সেখানে অন্নপান, খাবার জিনিস কাউকে কিছু দাওনি। সেই কারণেই খাবার হিসেবে তোমাকে সোনাদানা, মণিরত্ন দিয়েছি। বিশেষত পিতৃমাতৃকুলের কারও উদ্দেশে তুমি একটা পিণ্ড পর্যন্ত দাওনি, ফলে তোমার খাবার থালায় শুধু দানের জিনিস, কোনও অন্নপান নেই।
কর্ণ বললেন- দেখুন আমি তো সারা জীবন জানতামই না যে, আমার পিতা-মাতা কে, আমার পিতৃপুরুষের তালিকাতেই বা কারা আছেন? সেখানে আমি পিণ্ড দেব কার উদ্দেশে। ইন্দ্র বললেন– বেশ তো, এখন তো তুমি সব জানো। আর তুমি এত বড় দানবীর বলেই তোমাকে বলছি– তোমাকে আমরা পনেরোদিনের জন্য আবার মর্ত্যে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি– এই প্রতিপদ থেকে মহালয়া অমাবস্যা পর্যন্ত সময় ধরে তুমি পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ড দাও। তারপর মহালয়ার পরেই ফিরে এসো, তখন এখানেও তোমার সুব্যবস্থা হবে।
কর্ণ ফিরলেন ধরণীতে। পনেরোদিন ধরে পিতৃমাতৃগণের উদ্দেশে শ্রাদ্ধতর্পণ করলেন। তারপর যখন ফিরে স্বর্গলোকে, তখন ইন্দ্র বললেন– তোমার এই পিতৃমাতৃ কর্মের পনেরোদিন এখন থেকে পিতৃপক্ষ বলে জগতে পরিচিত হবে এবং এখন তোমার আবাসস্থান হোক এই পিতৃলোক।
কাহিনীটি জনশ্রুত পরম্পরায় বাহিত হলেও বেশ উদ্ভাবিত বটে। অতএব এই পিতৃপক্ষের শেষ দিন মহালয়া দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত কোনও মহোৎসব নয়, বরঞ্চ এটা পিতৃপুরুষের মহোৎসব– কোনও সময় তর্পণ না করলেও মহালয়ার তর্পণে সর্বসিদ্ধি। দুর্গাপুজোর সঙ্গে তার বাস্তব সম্পর্ক এইটুকুই যে, এই দিনেই দুর্গার মূর্তি কারিগরেরা অনেকেই দুর্গামূর্তির চক্ষুদান করেন— হয়তো-বা এই জন্যেই যে মা জননী চোখ খুলেই দেখবেন– তাঁর সন্তানেরা পিতা-মাতা পিতৃপুরুষকে ভোলেনি, মহালয়ার তর্পণ সেরেই তারা বিশ্বাত্মিকা জগজ্জননীর পুজো আরাধনায় মন দেবে, পাঁচদিনের সাড়ম্বর মাতৃতন্ত্র পনেরোদিনের পিতৃতান্ত্রিকতাকে পরের বছরের জন্য জমা করে দেবে।
ছোটবেলায় যখন পূর্ববঙ্গে গ্রাম্যজীবন কাটিয়েছি, তখন ঘরের পাশে নদী বয়ে যেত। পিতাঠাকুরকে দেখতাম তিনি প্রতিদিনই নদীর কোমরজলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করতেন। সেখানে মহালয়ার দিনটা আমার কাছে পৃথক কিছু ছিল না। তবে বিশেষ এইটুকু দেখতাম যে, এই দিনটাতে জ্ঞাতিগুষ্টির আরও কয়েকজন নদীতে নেমে তর্পণ করতেন। কিন্তু এই পার্থক্যের কারণটা আমার সেই ছোটবেলায় কিছু বুঝিনি, এমনকি মহালয়া নামটাও যে আমার কাছে খুব পরিচিত ছিল, তাও নয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে যেই কলকাতায় এলাম তখন আমার পিতার মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ দেখলাম– কারণ তিনি গঙ্গায় তর্পণ করতে পারছেন। ব্যাপারটা আরও জমে উঠল যখন আমার খুড়তুতো দাদা আমাদের বাড়িতে এসে বাড়ির বড় রেডিওর একটা জাল অ্যান্টেনা ছাদে লাগাতে গেলেন। তিনি বললেন, কাল মহালয়া, ভোর ৪টের সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী। অথচ উপলক্ষ্যটা একেবারেই অন্য ছিল– আমাদের কালীঘাটের বাড়িটা যেহেতু প্রায় গঙ্গার তীরেই ছিল ফলত পিতৃ-মাতৃহীন অনেকেই আমাদের বাড়িতে মহালয়ার আগের দিনই চলে আসতেন। মহালয়ার তর্পণ করবেন বলে। কিন্তু তর্পণের এই স্মার্ত বাধ্যবাধকতার মধ্যে হঠাৎই শরৎ-শিউলির একটা উন্মাদনা চলে এল সকাল ৪টের সময়। মুহূর্তের মধ্যে পিতৃপক্ষের শেষ দিন দুর্গাপুজোর প্রারম্ভিকে পরিণত হল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সৌজন্যে। আমি আগেও মহালয়ার দিন দেখেছি। তখনও মহালয়ার দিন দেখলাম। রাত্রি ১০টার সময় রেডিও-কাঁটাটিকে একেবারে যথাযথ তরঙ্গে স্থাপন করে তাকে বারবার পরীক্ষা করে রাখা হল, যাতে ভোর ৪টের সময় একটা সেকেন্ডে একটা শব্দও যাতে বিফলে না যায়। টেবিল ঘড়িতে ৩.৪০-এ অ্যালার্ম। যাতে সকলে চোখ-মুখ ধুয়ে রেডিওর ধারেকাছে বসে পড়তে পারে। বাচ্চারা যেমন বড়দের দেখলে ভয় পায়, তেমনিই বড়দের আনন্দ দেখলে তারাও আনন্দে উন্মাদনায় শামিল হয়। আমরাও তেমনই ছিলাম।
মহালয়া দু-তিন বছর এইভাবে চলার পর আমি একবার আমার বাড়িওয়ালি বৃদ্ধাকে দেখলাম– তিনি সকালে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার পরই দুর্গে দুর্গতীনাশিনী বলে সমস্ত ঘরগুলিতে গঙ্গাজল ছিটোলেন। আমি সেদিন বুঝলাম তিল-তুলসী-গঙ্গা শরৎ-শিউলি-কাশে পরিণত হল।
ছোটবেলায় গ্রাম্য কাকা-জেঠাদের বাড়িতে কেউ গতায়ু হলে সেই শোকতাপ আমাদের স্পর্শ করত। অবশেষে শ্রাদ্ধের দিন সেই বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে দুটি শব্দ এমনভাবেই পুনরাবৃত্ত হত। যাতে কোনও শব্দবোধ ছাড়াই কেমন যেন ভারাক্রান্ত হত আমার হৃদয়। একটা ছিল–ব্রাহ্মণায় অহং দদানি– আমি এটা ব্রাহ্মণকে দিচ্ছি। আর দ্বিতীয় বাক্যটি হল শেষের দিনে সেজন বিনে– ওঁ গয়া-গঙ্গা-গদাধরো হরিঃ। প্রিয়জনবিহীন মানুষটি প্রিয়জনের প্রতিরূপী ব্রাহ্মণকে দান করছেন– এতে ব্রাহ্মণত্ব খণ্ডিত হয় নাকি ব্রাহ্মণের লাভের পথ প্রশস্ত হয়, সে তর্ক থাক। কিন্তু গয়া গঙ্গা গদাধরো হরিঃ– এই বাক্যে প্রয়াতজন জীবিতজনের কাছে পিণ্ডলাভ করছেন অর্থাৎ খাবার পাচ্ছেন– এই ভাবনাটা অদ্ভুত এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করে দেয় মৃত এবং জীবিতের মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দেশে শ্রাদ্ধ-পিণ্ড অন্ত্যেষ্টির পরে একটা শ্রাদ্ধকৃত্যেই শেষ হয়ে যায় না। পিতৃ-মাতৃ-সুহৃদবর্গকে মনে রাখার জন্য বারবার বৎসরান্তিক তিথি ফিরে আসে– সপিণ্ডকরণ থেকে তিথি পালন কোনওটাই বাদ যেত না সেকালে।