- সেবন্তী ঘোষ
কবি পুরুষের চোখে নারী চিরকাল ‘শুশ্রূষার আলো’। অপেক্ষার বহুর রাধিকা ফুেরালে গৃহলক্ষ্মী সত্যভামা রুক্মিণীরা অবশেষে সংসারে আসেন। রাধিকার বাস চিরকাল দরজার ওপারে। চির প্রেমিকার অনন্ত প্রতীক্ষার কুঞ্জবনে। ভক্ত বৈষ্ণব পদকর্তারা রাধায় মজে থেকেছেন, বলা যায় নিমজ্জিত থেকে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান কবিতা উপহার দিয়ে গিয়েছেন। বাংলা সাহিত্য থেকে বাঙালির মুখের ভাষা, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে শ্রীমতী রাধা সদা বিরাজমান। মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমান কবির লেখায়ও তিনি সপ্রেমে, সসম্মানে ঠাঁই পেয়েছেন। মনে পড়ে রাজস্থানের কিশানগড় বাণী থানির কথা। ১৭৪৮ সালের রাজা সাওয়ান্ত সিংহের গায়িকা প্রেমিকা, সমাজের চোখে রক্ষিতা বিষ্ণুপ্রিয়া ওরফে বাণী থানি ভারতীয় ডাকটিকিটে চিরস্থায়ী হয়ে আছেন। পদ্ম কোরকের ন্যায় অক্ষি, চম্পক কলির মতো অঙ্গুলি তাঁর। সেই অঙ্গুলিতে ধরা এক অবনত পদ্ম।
রাজপর্ব শেষ হলে কৃষ্ণভক্ত সাওয়ান্ত বাণী থানিকে নিয়ে বৃন্দাবনে চলে আসেন। নিহাল চাঁদ নামে সে সময়ের বিখ্যাত শিল্পী রাধাকৃষ্ণের যেসব ছবি আঁকেন, তাতে সাওয়ান্ত সিংহ ও বাণী থানিকেই মডেল হিসেবে রাখা হয়েছিল। রাজারাই সে আমলে শিল্পীদের এমন ফরমায়েশ দিয়ে ছবি আঁকতে দিতেন।
বড় ঘরের ডাকসাইটে রাজপুতানী ধর্মপত্নীরা নন, সাওয়ান্ত সিংহ রাধা হিসেবে বেছে নিলেন বাণী থানিকেই। এই রাধা, গানের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী রসিকবিহারী ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন।
রাধা এভাবেই গল্প সাহিত্য সমাজ জীবনে মিলেমিশে থাকলেন। সম্পর্কে মাতুলানী, বয়সে বড় রাধা সমাজ নির্দেশিত পত্নীর খোপে আটকে থাকেননি। তার কৃষ্ণ প্রেমের রাধা বিরহ যেন ভক্তের ভগবানের কাছে পৌঁছানোর আকুতি। চৈতন্যদেব রাধাভাবে আচ্ছন্ন হয়ে, অধর রঙিন করে শাড়ি পরে পথে বেরোতেন। একই অঙ্গে অর্ধনারীশ্বরের মতো রাধা কৃষ্ণ বিরাজ করেন, এমন বিশ্বাস বহু বৈষ্ণবদের। মধ্যে কথা রাধাকে গৃহাঙ্গনে ঠাঁই না দিয়েও অশ্রদ্ধ করতে পারেননি কেউ। বহু নারী আসক্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের স্খলিত চরিত্র কৃষ্ণের কাছে পরস্ত্রী রাধা উপভোগের বস্তু, কিন্তু সে তো বিশেষ কোনও কবি কল্পনার নির্মাণ, যা তৎকালীন জনরুচি, সমাজের প্রতিফলন। ভারত জোড়া কৃষ্ণ ও রাধা কথায় সর্বত্র এমন শরীরের উদযাপন অবশ্যই নেই। কোথাও তা নিবেদন, দাস্য ভাব, কোথাও সখা সখী আলাপ। যতই রাধাকে ধর্মপত্নীর দয়িতা রূপে প্রতিষ্ঠা করুন বৈষ্ণব আচার্যগণ, রাধার পরকীয়াকে তত্ত্ব হিসেবে খাড়া করুন, রাধা কিন্তু কৃষ্ণের সন্তানের মা নন। মাতৃসত্ত্বা নেই বলে তাকে আমরা খোকাখুকুর মা গিন্নিবান্নি দেবী দুর্গার সঙ্গে এক করে দেখতেই পারি না। তিনি গার্হস্থ্যে থেকেও তার বাইরে থাকা প্রেমের কল্পনালতা। চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে রাত কাটিয়ে তার কাছে আসা কৃষ্ণের থেকে রাধা ঢের বেশি আদর্শ প্রেমিকা।
‘রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা’, এই অন্তরের কথায় পদকর্তারা আসক্ত থেকেছেন। যদুকুলপতি, কংস দমনকারী রাজা কৃষ্ণ নন, পাণ্ডব তথা অর্জুন সহায় কূটবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, রাধার কৃষ্ণ এক কৈশোর অতিক্রমকারী চপল তরুণ। রাধাও রাজরানি বা কন্যে নন। সাধারণ গোপবালা ও বধূ। লৌকিক এক প্রেমকাহিনীকে রথী-মহারথী ভক্ত কবিরা কেন এত গুরুত্ব দিলেন, কেন তাঁদের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি প্রায় এক নিম্নবর্গের জীবনের, সমাজ বহির্ভূত প্রেম, প্রতারণা, বিরহ বিচ্ছেদ ঘিরে বিস্তারিত হল, এ বড় ভাববার বিষয়। রাজার আমলের মানুষ তাঁরা, রাজারানি, বিদ্যা সুন্দরের মতো কাহিনী নির্বাচন স্বাভাবিক ছিল। কবি কল্পনায় গোরু গাছে ওঠে, রাধাও হতে পারতেন রাজদুহিতা। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের যে তা হয়নি। কবিরা, শ্রেষ্ঠ কবিরা, কবে আর সমাজ আর তার নিয়মের পরোয়া করেছেন?
মধ্যযুগের এইসব কবিরা কখনো-কখনো রাজার প্রশস্তি লিখেছেন, চাটুকারিতাও করেছেন কিন্তু স্বধর্মচ্যুত হননি। সীমাবদ্ধতার মধ্যেই গেরিলা আক্রমণে নিজেদের পছন্দের কথাগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন। শাক্ত পদাবলি, নাথ সাহিত্য যতই জনপ্রিয় হোক, রাধার কথা উচ্চারিত হয়েছে আরও শত মুখে। তাতে ধর্ম বাধা হয়নি এই কারণে যে রাধাকৃষ্ণ কথা, প্রেমতাড়িত অসহায় নরনারীর কথাই। সুবিখ্যাত হাছন রাজার বৈমাত্রেয় দিদি ছহিকা বা সহিফা বানু, (১৮৫১-১৯১৭) ছিলেন শ্রীহট্টের প্রথম মুসলমান কবি মেয়ে। তিনি লিখছেন, ‘মথুরাতে আছি আমি পাগল আমার মন/ রাধার জন্য সদা আমার প্রাণ উচাটন/…রাধার প্রেমে আছি বান্ধা জন্মের মতন/… ছহিফায় বলে শুন ভুবন মোহন/ কুব্জার কুবুদ্ধিয়ে তুমি হয়েছ বন্ধন।’
এদের অনেকের কাছে পরকীয়া বলে আদতে হয়ই না কিছু, কারণ শুদ্ধ প্রেম নিকষিত হেম। পরকীয়ার ভিতর ‘প্রেম’ শব্দটি বাদে সবটাই অর্থহীন। বিবাহ এক সামাজিক সুস্থিতি, সন্তান প্রবাহ পরিচালনা, অর্থ সম্পত্তি রক্ষা ও সমাজ সমর্থিত যৌনতার স্বীকৃতি মাত্র। রাধা সেখানে এক মূর্ত বিদ্রোহিনী। প্রেমলীলা সমাপনে কৃষ্ণ তাকে অনন্ত অপেক্ষায় রেখে কংস বধে চলে যান। তমাল তরু মূলে প্রতীক্ষায় থাকা চিরবিরহিনী রাধার যে পরবর্তীতে কী হল, তাবড় পদকর্তারা তার মধুর সমাপ্তি দিয়ে রসাভাস ধ্বংস করেননি।
পরবর্তীতে রাধার কথাই কৃষ্ণের পাশে মন্দিরে মন্দিরে খোদিত হল। রাধা স্বকীয়া না পরকীয়া, এ নিয়ে স্বয়ং নবাব মুরশিদকুলি খাঁর অনুমতিতে রাঢ় বঙ্গে এক মহা তর্কসভার আয়োজন হয়েছিল। উত্তরাপথের দুঁদে বৈষ্ণব তাত্ত্বিকরা রাধাকে স্বকীয়া বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জয়রথের চাকা উড়িয়ে এসেছিলেন। আসার পথে পরাজিত হয়েছিলেন প্রত্যেকে। কিন্তু রাধাভাবে প্লাবিত রাঢ়বঙ্গে তাঁদের বিজয় রথ থমকে গিয়েছিল। পরকীয়া হয়েই রাধার প্রেমের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন বাংলার বৈষ্ণব কবি, তত্ত্বিকরা। মুর্শিদকুলির আদেশে তাঁর সভার মুসলমান পণ্ডিতরা নিজেরা উপস্থিত থেকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এই খুঁটিনাটি তর্কবৃত্তান্ত। উত্তরাপথের, রাজস্থানের, উত্তর ভারতের সনাতনী মতকে প্রেমরসে নিমজ্জিত বঙ্গ কবিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেই কোন আমলে! রাধার কথা এখন আর কেউ বলুক, না তাকে ঠাঁই দিক তীর্যক পরকিয়ায়, তিনি আমাদের বসন্ত উৎসবের চির সিলসিলা।
(লেখক সাহিত্যিক ও শিক্ষক)