উত্তর সম্পাদকীয়

খাবার থেকে বিয়ে, সবেতেই বদল

 

  • অলকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

পয়লা বৈশাখ সারাদিন দম ফেলার সময় থাকে না বাঙালির। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে নববর্ষ উদযাপন। ভোরে পাড়ায় পাড়ায় প্রভাতফেরি, শোভাযাত্রা, পান্তাভাত, দোকানে দোকানে হালখাতা খোলা, মিষ্টিমুখ করিয়ে খদ্দেরদের হাতে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার তুলে দেওয়া, কোথাও মেলা, কোথাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তার সঙ্গে দিনভর পেটপুজো তো আছেই।

ইতিহাস বলে, মুঘল সম্রাট আকবর এই বাংলা সনের প্রথম প্রবর্তক। বাংলা ছিল কৃষিপ্রধান অঞ্চল। তখন চাষিদের খাজনা দেওয়ার সময় ফসল উঠত না। ফলে অসুবিধায় পড়তেন চাষিরা। আকবর মূলত তাঁদের কথা মাথায় রেখেই পয়লা বৈশাখ থেকে নববর্ষের সূচনা করেন। চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যেই পুরো বছরের খাজনা মিটিয়ে পয়লা বৈশাখ উৎসব পালন। একেবারে শুরুতে এটা ছিল প্রধানত কৃষি উৎসব। পরবর্তীকালে এই উৎসবই সর্বজনীন হয়ে ওঠে। তাই ফি বছর নববর্ষের দিনটা চরম ব্যস্ততায় কাটে আমবাঙালির। এই একটা দিন বাঙালি নিজের সংস্কৃতিকে আরও জড়িয়ে ধরে। পোশাক-আশাক, খাওয়াদাওয়া, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুতেই প্রকৃত বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা করে বাঙালি।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমানে বাংলা সাল নিয়ে আমবাঙালির যাবতীয় মাথাব্যথা নববর্ষের মতো দু’-একটি দিনকে ঘিরেই। পয়লা বৈশাখ ছাড়া এই তালিকায় রয়েছে পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণ। এর বাইরে বাংলা সালের সঙ্গে সিংহভাগ বাঙালির সেইভাবে কোনও যোগাযোগ নেই। অভিযোগ, বছরের এই তিনটি দিন নিয়েই তাদের যত আদেখলেপনা। অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য, বলা যাবে না। বাংলা তারিখ, বাংলা মাস তো দূরের কথা, আপনি রাস্তাঘাটে যে কাউকে বাংলা কোন সাল চলছে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাবেন কি না সন্দেহ। উত্তর দেওয়ার জন্য গুগল-দাদা অথবা সেদিনের বাংলা খবরের কাগজের শরণাপন্ন হতে হবে।

বাংলা সবক’টি মাসের নামও আজকের বাঙালি তরুণ-তরুণীদের ক’জন বলতে পারবেন বলা কঠিন। অথচ বাঙালির যে কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠান এখনও বাংলা মাস, তারিখ, তিথি দেখে ঠিক হয়। পঞ্জিকায় এই সব খুঁটিয়ে দেখার পরই ঠিক হয় বিয়ে, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, গৃহপ্রবেশের দিনক্ষণ। কথায় আছে, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। আগে নতুন বছর পড়তে না পড়তেই বাড়িতে এসে যেত একটি নতুন পঞ্জিকা। এখন পঞ্জিকার সেই সুদিন আর নেই। অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ঠিক করার ব্যাপারে বাড়ির গিন্নি-কর্তাদের অনেকটাই নির্ভর করতে হয় পাড়ার পুরোহিত মশাইয়ের ওপর।

বাংলা সাল নিয়ে আপামর বাঙালির হেলদোল নেই। হালখাতা খোলা এখনও বহু দোকানে হলেও বাংলা ক্যালেন্ডার ছাপানো অনেক কমে গিয়েছে।  দশ-পনেরো বছর আগে পয়লা বৈশাখে খদ্দেরদের হিমশীতল শরবত, রাজভোগ, পান্তুয়া, জিলিপি, চমচম, নিমকি খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হাতে একটি করে বাংলা ক্যালেন্ডারও তুলে দিতেন দোকানিরা। গৃহকর্তা বাড়ি ঢোকামাত্র গিন্নি ছোঁ মেরে ক্যালেন্ডারটি কেড়ে নিয়ে দেখতে বসে যেতেন, কবে জামাইষষ্ঠী, কবে রথযাত্রা, কবে বিশ্বকর্মাপুজো, কবে মহালয়া, কবে সপ্তমী, কবে কালীপুজো, কবে ভাইফোঁটা। এখন বাংলা ক্যালেন্ডার বিশেষ দেখাই যায় না। তার ফলে পুরোনো দিনের মানুষ, বিশেষত মহিলারা বেশ সমস্যার মুখে পড়েন। গোটা পাড়ায় নববর্ষে হয়তো এখন এক-আধটা দোকানেই বাংলা ক্যালেন্ডার ছাপায়। আর সেই ক্যালেন্ডার দোকানে ঢুকতে না ঢুকতেই সব শেষ। সর্বত্র ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ছড়াছড়ি। কিন্তু বাংলা ক্যালেন্ডারের অবস্থা সেই ‘তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই’ গানের মতো।

সত্যি কথা বলতে, শুধু বাংলা সন-তারিখই নয়, বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি খাওয়াদাওয়া থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে আমবাঙালি। জনমত সমীক্ষা হলে এখনও হয়তো পয়লা বৈশাখে প্রিয়জন, পরিচিত, অপরিচিতকে ‘শুভ নববর্ষ’ বলে শুভেচ্ছা জানানোর প্রথাই শীর্ষস্থান দখল করবে। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যেভাবে হিন্দি ও ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটছে, তাতে অদূরভবিষ্যতে স্থানচ্যুত হতে পারে ‘শুভ নববর্ষ’। তার জায়গায় বলতে শোনা যায়, ‘হ্যাপি একলা বৈশাখ’, এমনকি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ও। কেউ একজন বলল, ‘শুভ নববর্ষ’, তার পালটা ‘সেম টু ইউ’ বলতে শুনলেও অবাক হবেন না। এভাবেই ‘শুভ দোলযাত্রা’র জায়গা নিয়ে ফেলেছে ‘হ্যাপি হোলি’। ‘শুভ দীপাবলির’ স্থান দখল করেছে ‘হ্যাপি দিওয়ালি’। কথ্য বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এখন কার্যকর্তার মতো অজস্র হিন্দি শব্দের ছড়াছড়ি। মনে পড়ে যায়, সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় ট্রেনে ফেলু মিত্তিরের উদ্দেশে জটায়ুর বিখ্যাত ডায়ালগ,   ‘দূর মশাই, আমি গড়পারের লোক। হিন্দি কেউ সাধে বলে নাকি?’

নেহাতই ছাপোষা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মা সন্তানকে বাড়িতে সারাক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলার জন্য চাপ দেন। আজ থেকে কত বছর আগে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখে গিয়েছেন, ‘ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না/ জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা …’।

পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ট্যাঁকের জোর না থাকলেও অভিভাবকরা মোটা টাকা দিয়ে নিজেদের সন্তানকে ভর্তি করছেন এই সব স্কুলে। ইংরেজি শেখার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু এই স্কুলগুলোর অধিকাংশেরই বাহ্যিক আড়ম্বরই সার। কোনও একটা ছুতোয় অভিভাবকদের কাছ থেকে দফায় দফায় থোক টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এদের উদ্দেশ্য। ফলে পড়ুয়ারা না শেখে ইংরেজি, না শেখে অন্য কোনও ভাষা। এখন শিশুমন মগ্ন কার্টুন, ভিডিও গেম, হ্যারি পটারে। ঠাকুমার ঝুলি, রূপকথার গল্প তো দূরের কথা, রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ও উলটে দেখার ফুরসত নেই তাদের।

নববর্ষে বাঙালির পেটপুজো একটা বড় ব্যাপার। কিছুকাল আগে পর্যন্ত‌‌‌ বাড়িতে এইদিনে পোলাও, পাঁঠার মাংস ছিল বাঁধা। তার সঙ্গে থাকত মাছের নানা পদ, কাঁচা আমের চাটনি আর বাঙালির প্রিয় মিষ্টিদই। এখন বহু বাড়িতেই রান্নার ঝামেলা রাখতে চায় না। নববর্ষে অনেক হোটেল, রেস্তোরাঁ বাঙালি রান্নার আয়োজন করে। অনেকেই আগাম টেবিল বুক করে রাখে। কোথাও কোথাও বিরাট লাইনও পড়ে। যতই নামী রেস্তোরাঁ হোক, বাড়িতে যেভাবে বিভিন্ন পদ রান্না করা হয়ে থাকে, আর যাই হোক, সেসব পদের স্বাদ মা, ঠাকুমাদের মতো হয় না।

এখন বাঙালি বিয়েতে মেহেন্দি, সংগীত, বরকে ঘোড়ায় চাপিয়ে নাচতে নাচতে বরযাত্রীদের আসা, বিয়ের মণ্ডপে ডিজের গান, আমন্ত্রিতরাও কোমর দোলান। খাওয়া শুরু হয় ফুচকা দিয়ে। হারিয়ে গিয়েছে নাপিতে নাপিতে লড়াই, বিয়ে উপলক্ষ্যে পদ্য লেখা, বাঙালি বিয়ের সেই ঐতিহ্য। বরং ভিনরাজ্য বা বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা বাঙালিয়ানা রক্ষা করার ব্যাপারে অনেক বেশি আন্তরিক। পুজোপার্বণ, আচার, অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অনেক নিষ্ঠা দেখা যায়। আবার এই রাজ্যে বসবাসকারী অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারা তাঁদের নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেন না। আমরাই বেশি উদারচেতা হতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিতে চলেছি। আমরা যদি নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে যত্নশীল এবং আন্তরিক না হই, তাহলে একদিন খরাজ মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটাই হয়তো আমাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়াবে। গর্ব করার মতো আর কিছুই থাকবে না।

‘হায় বাঙালি হায়, তুই আর বাঙালি নাই, তোর চলনবলন কথার ধরন নিজের মতো নাই ও তুই আর বাঙালি নাই …’

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Teesta canal | তিস্তা ক্যানালে জমেছে পলির পুরু স্তর, তিন প্রকল্পে ক্ষতির শঙ্কা

রণজিৎ ঘোষ, শিলিগুড়ি, ২০ মে : ফুলবাড়ি থেকে ক্যানাল রোড ধরে যতই গজলডোবার দিকে এগোনো…

19 mins ago

Weather Forecast | চলতি সপ্তাহে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি, উত্তরে বর্ষা এখনও অনিশ্চিত

সানি সরকার, শিলিগুড়ি: রাতভর বৃষ্টি, সকাল হলেই চড়া রোদ। কখনও একধাক্কায় তাপমাত্রার পতন, কখনও আবার…

34 mins ago

BSF | যৌনাঙ্গে লুকিয়ে সোনা পাচারের চেষ্টা! ভেস্তে দিল বিএসএফ

হিলি: যৌনাঙ্গে লুকিয়ে শোনা পাচারের ছক ভেস্তে দিল সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। সোমবার বিকেলে হিলি সীমান্ত…

9 hours ago

Delivery Boy | তাপসী পান্নুকে সামনে দেখেও চরম নিস্পৃহ ডেলিভারি বয়, ভাইরাল ভিডিও

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বলিউডের অভিনেত্রীকে সামনে দেখেও নিষ্পৃহ একটি ফুড ডেলিভারি অ্যাপের ডেলিভারি বয়।…

9 hours ago

Lok Sabha Elections 2024 | দিনভর বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা! দিনের শেষে শান্তিতেই ভোট, দাবি কমিশনের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিক্ষিপ্ত কিছু উত্তেজনার ঘটনা ছাড়া মোটের উপর শান্তিতেই মিটল পঞ্চম দফার…

11 hours ago

Bengal Police | পঞ্চম দফা ভোটের দিনই অপসারিত পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি, খোঁচা অভিষেকের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ভোটের (Lok Sabha Election 2024) আবহে রাজ্য পুলিশে (Bengal Police) রদবদল…

12 hours ago

This website uses cookies.