দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
এমনটাও তাহলে হতে পারে। নিরঙ্কুশ মোদি সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করা যায়। সংসদে নির্লজ্জভাবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া তিন-তিনটি আইনকে প্রায় এক বছরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা রাস্তার লড়াই দিয়ে বাতিল করে দেওয়া যায়। কোনও কঙ্গনা রানাওয়াত হয়তো বলবেন, গুরু নানকের জন্মদিনে মোদি সরকার কৃষকদের উপহার বা ভিক্ষা দিল। কিন্তু কত বড় ঘটনা চোখের সামনে ঘটে গেল, তা বুঝতে নিশ্চয়ই দেশবাসীর অসুবিধা হবে না। এমন ঘটনাকেই তো প্রকৃত অর্থে ঐতিহাসিক বলা যায়।
য়ে যাই বলুক, ইতিহাস ফুরিয়ে যায়নি। ফুরোয় না। ৭০০ প্রাণের বিনিময়ে ভারতের চলমান রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখলেন কৃষকরা। গত বছরের ২৬ নভেম্বর এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূচনা দেখেছিলাম আমরা। দেশের অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন মিলিতভাবে সারা ভারত ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। একই দিনে দেশজুড়ে কৃষকরাও রাস্তায় নেমেছিলেন মোদি সরকারের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে।
এমন ধর্মঘট ও প্রতিবাদের সমাহার মোটেই অচেনা নয়। গত তিন দশকে বেসরকারিকরণ, বাজারিকরণ ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বহু প্রতিবাদ এ দেশ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু ২৬ নভেম্বর যেটা ঘটেছিল, সেটা ছিল আনকোরা নতুন। হরিয়ানার কৃষকদের সমর্থন নিয়ে পঞ্জাবের কৃষকরা দিল্লি সীমানায় এসে ধর্নায় বসেছিলেন। রাস্তাকে আক্ষরিক অর্থেই ঘর বানিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে প্রতিবাদী ছাউনিতে বসে থেকেছেন কৃষকরা। তিন আইন বাতিল হওয়া কৃষকদের এই ক্লান্তিহীন নির্ভীক প্রতিবাদের বড় জয় নিঃসন্দেহে।
আইন তিনটি বাতিলের ঘোষণা করেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য বলেছেন, আইনে কোনও ত্রুটি ছিল না। সমস্যা হল, কৃষকদের এক বিশেষ অংশকে এই আইনের প্রয়োজন ও লাভ সরকার নাকি এক বছরে বুঝিয়ে উঠতে পারেনি। এই না বোঝাতে পারার অক্ষমতার জন্য দেশবাসীর কাছে ও আইনটির সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন অধ্যায় শুরু করার কথা বলেছেন তিনি।
কৃষকরা ক্রমবর্ধমান কৃষি খরচের পরিপ্রেক্ষিতে যে ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের আইনি গ্যারান্টি চাইছেন, সেসম্পর্কে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কিছুই বলেননি। বলেছেন, জিরো বাজেট কৃষি পরিকল্পনা ও নতুন কমিটি বানানোর কথা। বোঝাই যাচ্ছে, এক পা পিছু হটলেও অন্য পথে, অন্য কৌশলে কৃষিকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার সরকারি অভিয়ান অব্যাহত থাকবে। তবুও এই জয় বিরাট জয়।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদি ২০১৩ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন করে কর্পোরেটের হাতে জমি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে সুগম করতে চেয়েছিলেন। তখনও কৃষকদের সম্মিলিত প্রতিবাদের কাছে মোদি সরকারকে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। সে তো আজ থেকে ৭ বছর আগের কথা। পদ্মশ্রী কঙ্গনা রানাওয়াত-এর হিসেবে তখন ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে। তখনকার পিছু হটা আর এবারের পিছু হটা এক নয়।
কৃষক আন্দোলনকে ভারত বিরোধী খালিস্তানি ষড়য়ন্ত্র বলে জনগণের চোখে ক্রমাগত হেয় করার চেষ্টা হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-শিখ কৃষকের মৈত্রীবন্ধনকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজনের বিষবাষ্পে কবলিত করার চেষ্টা হয়েছে। মন্ত্রী-পুত্রের উদ্ধত গাড়ির নীচে প্রতিবাদী কৃষকদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান চলেছে। এত কিছু করার পর যখন এক বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী আইন বাতিল করার ঘোষণা করতে বাধ্য হন, তখন তা অবশ্যই কৃষক ঐক্য ও আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয়।
আগামী বছরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর ও গোয়ার বিধানসভা ভোট। নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কা দেখেই যে সরকারের এই পিছু হটার রাজনৈতিক কারণ বোঝা কঠিন নয়। পিছু হটার জন্য গুরু নানকের জন্মজয়ন্তীকে বেছে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। যদি পঞ্জাব, হরিয়ানা, লখিমপুর খেরির কৃষকদের মন একটু জয় করা যায়।
বাংলার পাঠকদের হয়তো মনে পড়বে এই দিনটা আরও একজন বিখ্যাত মানুষের জন্মদিন। তিনি হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো- এই কালজয়ী গানের স্রষ্টা সলিল চৌধুরী। জান কবুল আর মান কবুল করে কৃষকদের সংগ্রাম ও শপথের গান লিখেছিলেন তিনি। কৃষকদের জয় নিঃসন্দেহে সেই সংগ্রামী চেতনা ও দৃঢ় শপথের জয়। এই চেতনা, এই শপথ আইন বাতিলের কথা শুনে অবশ্যই শিথিল হয়ে পড়বে না। সলিল চৌধুরীর গানের ভাষায় বলতে গেলে দ্বিগুণ শক্তিতে জ্বলে উঠবে কৃষকের প্রতিরোধের আগুন।
আন্দোলনরত কৃষকদের এতদিন দেশদ্রোহী, উন্নয়ন বিরোধী বলে এসেছেন কৃষি আইনের সমর্থক, নেতা ও প্রবক্তারা। আজ তো সবার আগে তাঁদের কৃষকদের কাছে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কৃষকদের হুমকি দেওয়া ও কৃষকদের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদানকারী নেতাদের এখন অপসারণের সময়। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র হোন অথবা হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার হোন।
যে সাত শতাধিক কৃষক এই আন্দোলন চলাকালে প্রাণ হারিয়েছেন, সেই শহিদদের সম্মান জানানোর সময় এখন। সমস্ত শহিদ পরিবারের কাছে দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান এখন সরকারের ন্যূনতম কর্তব্য। শুধু তিনটি কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা নয়, সংসদের আগামী অধিবেশনে ঋণমুক্তি ও সমস্ত কৃষকের সমস্ত ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার কথাও সরকারের ঘোষণা করা উচিত।
কৃষক আন্দোলনের জয় অবশ্যই গণ আন্দোলনের জয়, ব্যাপক জনগণের ঐক্য, ধৈর্য ও দৃঢ় সংকল্পের জয়। পঞ্জাবের কাছ থেকে আজ গোটা দেশের শেখা উচিত, একটা পুরো রাজ্য, পুরো সমাজ কীভাবে কৃষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারে এবং বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিতে একটা অক্লান্ত আন্দোলন কীভাবে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে।
এই জয় অবশ্যই কোম্পানিরাজ বা কর্পোরেট আগ্রাসন বিরোধী অন্যান্য আন্দোলনকে উৎসাহিত করবে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা ইউএপিএ ও রাজদ্রোহের মতো বিভিন্ন দানবীয় আইনের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলমান সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
কৃষকদের মূল লড়াইটা ছিল কৃষিকে কর্পোরেট লুণ্ঠনের হাত থেকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখার লক্ষ্যে। আজ দেশের সমগ্র অর্থব্যবস্থাটাকেই কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কৃষি আইনের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নতুন শ্রম কোড, যাতে অর্জিত অধিকার কেড়ে শ্রমিককে কেনা গোলামে পরিণত করা যায়। চালু হয়েছে দেশ বিক্রির পাইপলাইন, যা জনগণের অর্থ ও ত্যাগের মাধ্যমে নির্মিত জাতীয় সম্পত্তিকে আদানি-আম্বানিদের হাতে তুলে দেবে।
কৃষি আইন বাতিলের পাশাপাশি কর্পোরেট আগ্রাসন ও লুণ্ঠনের এই ছকটাকে বাতিল করার দাবি তুলতে হবে এখন। কৃষকদের এই জয় নিঃসন্দেহে মোদি সরকারের ক্ষমতার অহংকার ও আগ্রাসনের পরাজয়। নির্বাচনে জনগণ মাঝে মাঝে এই সরকারকে জোরালো ধাক্কা দিয়েছে। যেমন ঠিক দুবছর আগে ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে, আর এ বছরের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এবারের পরাজয়ে পরিপ্রেক্ষিত ও তাৎপর্য অনেক ব্যাপক।
সরকার সমর্থক প্রচারতন্ত্র এই বড় পরাজয়কে প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতা বলে দেখাতে চাইছে। আসন্ন পরাজয় ঠেকানোর মরিয়া প্রচেষ্টায় কৃষি আইন বাতিল হয়ে উঠেছে মাস্টারস্ট্রোক। ধারণা তৈরি বা পারসেপশন ম্যানেজমেন্টের এই লড়াই চলতে থাকবে। কিন্তু যখন রাস্তার লড়াইয়ে কৃষক আন্দোলন জয়যুক্ত হচ্ছে, তখন এই ধারণার লড়াইয়ে জনগণকে কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
(লেখক সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক)