মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
শীতের বেলা। দিন গড়িয়ে যায় দ্রুত। ক্রমশ ঝলমলে সবুজ স্কুলের গাছ, শাখাপল্লব, ঘাসের শুকনো অথচ পেলব তরতাজা ভাব ঠান্ডা হতে থাকে। হাতের মোবাইলে তখন পরিসংখ্যানে ডুবে থাকেন কয়েকজন মানুষ। বড় সিরিয়াস, বড় অনুভবী। কপালে চিন্তার ভাঁজ। শীতের শুকিয়ে থাকা ত্বকে খড়ি ওঠে। সকালটা একরকম, বেলা যত গড়িয়ে সন্ধের দিকে ততই মন ভার ভার। খুশি মনে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী সাড়ে নটায় ঢুকে গিয়েছিলেন ভারী মাইনাস পাওয়ারের চশমা আর মাস্কে মুখ ঢাকা স্কুল প্রধান। তারিখ ১৬ নভেম্বর। একে একে অন্য শিক্ষকরাও নির্ধারিত সময়ে আধঘণ্টা আগে। উদ্বেল সবুজ উত্তেজনা। রোদ মেখেছে বড় গেট আর বিরাট মাঠ।
স্কুলে সাজোসাজো রব ছিল গত সাতদিন ধরে। এর আগেও ১২ ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খোলার এক চেষ্টা হয়েছিল, পরীক্ষাও হয়েছিল কিন্তু আবার পরিস্থিতি বিরূপ। ফলত, স্কুল রুটিন পরিবর্তন, পরিবর্ধন চলছে নির্দেশ অনুযায়ী। এবার সময় বদল সুতরাং পিরিয়ড স্প্যান কখনও চল্লিশ মিনিট কখনও পঁয়ত্রিশ…। টিফিনের সময় ধার্য হয়েছে। কিন্তু ওই তো ঘরে বসে বেঁধে রাখা। সবসময় নজরদারি হয় না। তোতাকাহিনীর পাখিটাকে মনে পড়ে। নিজে থেকে খুঁটে খেতে শেখা, উদার আকাশে ডানা মেলা কিংবা গুটিগুটি বন্ধুত্ব, সব বন্ধ। মাথায় মাথায়, কানে কানে ফিশফিশ না হলে আর হৃদ্যতা কীসে! সব বুঝেছি। বেঞ্চের এ প্রান্ত কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, হে বন্ধু…কতদিন পর দেখা! আ গলে লাগ যা! শিক্ষক পিছন ফিরতেই ওরা একসঙ্গে। এবার ১৬ নভেম্বরে আরও একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে দুহাত দূরত্বে হাঁটতে শুরু করার আগে থার্মাল গানে টেম্পারেচার পরিমাপের পরীক্ষা দিয়ে দুহাতে স্যানিটাইজার মেখে রোদে স্নান সেরে লাইন দিয়ে যে যার নির্ধারিত ক্লাসে ঢুকছে। বহুদিন পর বেল বেজেছে। ভারী পিতলের ঘণ্টার আওয়াজ কেমন নস্টালজিক। প্রতিদিনের লেট লতিফ সুইপার আজ দশটা না বাজতেই কাজ শেষ। হেরিটেজ বিল্ডিং সামান্য পুরোনো ধাঁচের হলেও পরিচ্ছন্ন চকচকে। পঁচিশ বিঘা জমি একেবারে সুষ্ঠু সুন্দর করে তোলা একদিনের কাজ তো নয়! সঙ্গে টেনশন ফ্রি। ছাত্রছাত্রী সংক্রামিত হবে না তো! এখন সামান্য ধুলোতেও অবিশ্বাস। স্পর্শে সন্দেহ।
প্রথমদিন হইহই করে শুরু হলেও সব স্কুলে উপস্থিতি সমান নয়। আনন্দে, আবেগে, আগ্রহে সবাই যে এসে উপস্থিত হবেই এমন ভাবনা তো ভুল। একখানা ঘোষণা তো ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো ছিলই। যাঁরা মনে করবেন ছেলেমেয়েকে পাঠাবেন, নয়তো নয়- এর মানেটা কী বুঝিনি।
এমনিতেই উচ্চমানের সুবিধাযুক্ত স্কুলেও দশম ক্লাসে উঠে গেলেই ছাত্রছাত্রীর বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার কমতে থাকে। সেটা বিগত কুড়ি বছর ধরে আমরা অভ্যাস করে ফেলেছি। প্রচুর পদ্ধতি, বকুনি, শাস্তি, নম্বর কাটার ভয় দেখিয়ে প্যানডেমিকের আগেও ছাত্রছাত্রীকে প্র্যাকটিকালের ক্লাসের দিন ছাড়া স্কুলে আনা যায়নি। কারণ লিখতে বলা হলে বেশিরভাগ লিখেছে, প্রাইভেট পড়া ছিল, ভ্যান দেরি করেছে ইত্যাদি। তাহলে কোভিড ছায়া সঙ্গে নিয়ে স্কুলে উপস্থিতিটাও যদি ঐচ্ছিক করে দেওয়া হয়, তাহলে স্কুল, পাঠ ভালোবেসে কজন আর স্কুলে উপস্থিত থাকবে!
দেখা গেল, পঞ্চাশ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গড়ে প্রায় প্রতিটি স্কুলে প্রথমদিন উপস্থিত। আমরা আনন্দিত, প্রফুল্লও। কোনো কোনো স্কুল প্রথমদিন নানা অনুষ্ঠান কর্মসূচি রেখেছিল। প্রবেশদ্বারে হারমোনিয়াম সহ সংগীত, মিষ্টি বিতরণ সবই হল, ছাত্রছাত্রীর কপালে তিলকফোঁটাও পরানো হল, এসব কেন বুঝিনি সত্যিই। নিজেদেরই প্রতিষ্ঠানে একটু শুধু সাবধানতা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করাই যথেষ্ট ছিল নাকি? হ্যাঁ, যদি আক্ষরিক অর্থে প্রবেশদ্বারে ক্যাম্প বসিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত, সেটাই হত মহৎ কাজ। তবে অনেক ছাত্র ব্যাট-বল সঙ্গে নিয়ে স্কুলের মাঠকে ব্যবহার করেছে, এ ছবিতে মন ভরে গিয়েছে।
অন্য ছবিও আছে। ছাত্রীমহলে মোবাইল আনা স্কুলে নিষেধ সত্ত্বেও লুকিয়ে নিয়ে এসে ক্লাসঘরে শিক্ষকের অনুপস্থিতির সুযোগে জগঝম্প গান চালিয়ে পরস্পর নৃত্যরত ছাত্রীদেরও ছবি উঠে এসেছে। সে ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছাত্রীদের মৃদু ভর্ৎসনা করে সে ভিডিও ডিলিটও হয়েছে। পূর্ব পরিস্থিতি হলে অভিভাবকরা স্কুলের আহ্বানে দুরু দুরু বক্ষে স্কুল কর্তৃপক্ষের শাস্তি বিধান শুনতেন, কিন্তু স্কুল খোলার প্রথমদিন বলে কথা, ওদের আনন্দে মোবাইল নৃত্যেও ছাড় দেওয়া ছাড়া গতি কী? পরদিন যে আর ইচ্ছেই করবে না স্কুলগেট পেরোতে! আর মোবাইলে নিষেধাজ্ঞা আনার আমি, আপনি কে! ওই বস্তুটিই তো এই দুবছরের ঘরবন্দি জীবনে ওদের একান্ত আপন হয়েছে। গ্লোবালাইজেশনের পোক্ত ধাপে ওরা এগিয়ে গিয়েছে আরও কয়েক পা।
শুধু কি ক্লাস! কত উন্মাদনা, কত গেম, কত ভিডিও, কত কত হাতছানি। যে সমস্ত অভিভাবক প্রাণপাত করে নিরলস ওদের সঙ্গে থেকেছেন, হাতেগোনা সে কজন ছাড়া অনলাইন ক্লাস কী, কজন জানেন! অ্যাটেনড্যান্স দিয়ে যে সরে পড়া যায় তেমন উদাহরণও আছে। এই অভ্যেস রপ্ত যখন, খুলেছে স্কুল। হইহই করে স্কুলগেটে দৌড়ে এসে দাঁড়াবে প্রতিদিন সবজি বিক্রি করে সামান্য পয়সার মুখ দেখা ছেলেটা! সবাই সমান উৎসাহে স্কুলে আসবে এটা ভাবা যায় না। প্রথমদিন থেকে সময়ে জাঁতাকলে নির্দ্বিধায় বসে থেকেছে ছাত্রছাত্রী। বিষয়ে যে কজন হাতেগোনা শিক্ষক বা শিক্ষিকা আছেন, নতুন রুটিনে কোভিডবিধি মেনে বিশেষ পদ্ধতিতে বসা ছাত্রছাত্রীকে স্যানিটাইজার ব্যবহার, মাস্ক ব্যবহারের উপযোগিতা, ভাইরাস বিষয়ক জ্ঞান দিয়ে পাঠ্য বিষয়ে ঢুকছেন। যেসব স্কুলে টিফিন আছে তারা শুকনো খাবার নির্ধারিত সময় বিতরণ করেছে ক্লাসঘরেই।
তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। কলকাকলিতে বেলা পড়ে এলে ছুটির ঘণ্টা ঢং ঢং বাজতেই লাইন করে দূরত্ব বজায় রেখে গুটিগুটি স্কুলবাড়ির গেট পেরিয়েছে ওরা। ছুটির ঘণ্টার পর হইহই করে ছোটা ইতিহাস আজ।প্রথমদিনের আনন্দ সবাই মিলে ভাগ তো করে নেওয়া গেল। সাঁঝের পাখির সঙ্গে আমরাও ঘরে ফিরেছি। আবার আলোচনা, প্রতি উত্তর সব মিলিয়ে সময়ে ধারাভাষ্য, রুটিন আবার বদলে গিয়েছে। আমরা সবেতেই সিদ্ধ। শনিবারের অভিভাবক-শিক্ষক সভাও বাদ যায়নি। শুরু হয়েছে স্কুল ঘিরে খোলা আকাশের নাট্যমঞ্চ। উপস্থিতি কমতে শুরু করেছে পঞ্চাশ শতাংশ থেকে ত্রিশ শতাংশে। শ্রেণি সংখ্যা কমিয়ে এক-একটি ঘরে দুজনকেও বসতে দেখা গিয়েছে। ওই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই তিনদিন, দুদিনের গল্প। প্রতিদিন ক্লাসের বদলে শনিবারের গঠনমূলক আলোচনা। তাতে পরীক্ষা বিষয়ক সময়, রুটিন সব নিয়ে কথা।
এভাবেই প্রতিদিন ভোর হয়। রোদ করোজ্জ্বল হেমন্ত শেষের আলো। অল্প শীতে ডানা মেলা একা চিল উড়তে উড়তে নামে সবুজ মাঠের মধ্যিখানে। নির্ভয়ে রাজার মতো দাঁড়ায় ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা শিক্ষালয়ে প্রতিদিন সময় বদলায়। ঘণ্টা বাজে। সাড়ে নয় আর নয়। এখন সাড়ে দশ। কিছু মানুষ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে পরবর্তী নির্দেশিকার, যা তোতাকাহিনীর তোতাকে উড়িয়ে দেবে ইচ্ছেমতো।
(লেখক কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষক)