- আশুতোষ বিশ্বাস
কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে উত্তরবঙ্গের কলেজে যুক্ত হওয়ার সুপারিশপত্র হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন-ময়ূরী পেখম তুলে নাচতে শুরু করে দিল। আমি যে এবার চরম রুক্ষ পুরুলিয়া জেলা থেকে সবুজের দেশে যাব! মেঘ যেখানে গাভীর মতো চরে। হিমালয় থেকে আসে বরফ শীতল-স্পর্শ, কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্ণালি আলোকচক্র থেকে ভগবান বুদ্ধ আশীর্বাদ-মুদ্রায় আমাদের দেখছেন। বৃষ্টির ছাট এসে অবিন্যস্ত চুল দেয় ভিজিয়ে।
সত্যিই যখন আলিপুরদুয়ার রওনা দিলাম, তখন যে আর পা এগোতে চায় না। কুড়ি বছরের কর্মস্থল, অন্ন উপার্জনের প্রথম শহর মানবাজারের জন্য মনটা হুহু করে উঠেছিল। পুরুলিয়া রুখা হোক, শুখা হোক সে আমার। নুড়ি, কাঁকড় লালমাটিতে প্রাণের স্পন্দন। অসমতল দিগন্তজোড়া খাঁখাঁ প্রান্তর। চৈত্রের দহন-দুপুর আগুন ঝরাতে ঝরাতে সর্পিল পিচপথ মিশে গিয়েছে দূরে সোনাঝুরি শালবনের গাছের আড়ালে। আপনি ভ্রমণবিলাসী হেঁটে চলেছেন, একটু পরেই দেখবেন আপনার কেশদাম সোনাঝুরি ফুলের হলুদ পরাগে ভরে গিয়েছে। আপনার চোখ যাবে পলাশ বিছানো পথের কিনারে, যেখানে অজস্র রক্তিমপলাশ ফুল কেউ ছড়িয়ে রেখেছে! ডান-বাম যেদিকেই চোখ পাতবেন পলাশের হাতছানি পাবেন- যদি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মুসাফির হন।
দহন-ক্লান্ত রাখাল গোরুরপাল প্রান্তরে ছেড়ে দিয়ে পলাশ গাছের তলায় গামছাখণ্ডকে বালিশ করে নির্বিকার ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের অসুখী মনের হারমোনিয়ামে বেজে ওঠা গানের ধুন থমকে দাঁড়ায়- আদিবাসী পরিবারের মাটির দাওয়ায় এসে। টিলা, পাহাড়, বনবাদাড়, শালপিয়ালের গাছের তলায় একদণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার স্বর্গসুখ। রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে সংগত নেওয়া পুরুলিয়ার আদিবাসী মানুষগুলি আমার প্রাণের মানুষ। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাটুকু মিটে গেলেই তাদের আনন্দ। যে আনন্দে কুমারী, কংসাবতী, দামোদর, সুবর্ণরেখা ছুটে যায় পাহাড় পেছনে ফেলে। খেলা-মেলা-নাচ-গান, ছৌনাচ, ভাদু, টুসু, করম, মোরগের লড়াই, কাড়া লড়াই নিয়ে ঋতু রঙ্গশালায় তারা নটরাজ। সন্ধে গড়ানো হ্যাজাক-জ্বলা মোরগ লড়াইয়ের মাঠে একজন মোরগ বিজয়ী মনিবের কী যে আনন্দ তা ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য। পশুপালন, কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আদিবাসী সাঁওতাল, মুন্ডা ও ওরাওঁ, কুর্মি জনজাতির নারী-পুরুষ হাটে-মাঠে খাটে, প্রাণ খুলে হাসে।
এলাম উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার শামুকতলা কলেজে। সবুজ ঘাসের নরম গালিচায় মোড়া কলেজ-প্রাঙ্গণ, পাশে আমলকী বন। বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা বলে এখানকার তিস্তা, তোর্ষা, জলঢাকা, ব্রহ্মপুত্র, কালজানি নদীকণ্ঠের গান থামে না। রাভা, বোরো, তামাং, ভুটানি, অসুর, টোটো, রাজবংশী জনজাতির মানুষ স্বীয়-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল। কৃষি, বনসম্পদ এবং চা বাগান শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে এদের জীবিকা। বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্প, জলদাপাড়া অভয়ারণ্য, জয়ন্তী, চিলাপাতা পর্যটনকেন্দ্রগুলি স্থানীয়দের আয়ের পথ। সদ্য-আগন্তুক আমার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেল যে আমি এই জনপদেরই একজন। মাসকয়েক আগে স্ত্রীর এ-নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের দরকার হয়েছিল। আমি সন্ধেবেলায় কলেজ থেকে ফিরে ফোন করেছিলাম কলেজের সহকর্মীকে। রাত এগারোটার সময় একজন রক্তদাতাকে সঙ্গে করে সে হাজির! সেই রক্তে সে যাত্রায় স্ত্রী প্রাণে বেঁচে গেল। পরে সে যখন বলেছিল, স্যর, সেদিনের সেই রক্তদাতা ছেলেটি তার বন্ধুর ভাই, ওরা জাতিতে মুসলমান! আমি নির্বাকদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চেয়ার থেকে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম মনে নেই।
(লেখক শামুকতলা সিধো-কানহো কলেজের অধ্যক্ষ। আলিপুরদুয়ার)