অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
জীবনের পঞ্চাশ বছরে পৌঁছেও কবি ভোলেননি সতেরো বছর বয়সে বিলেতে তাঁর নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া দু’খানি বাংলা অভিধানের কথা। সেইসঙ্গে বাংলা ভাষা পরিচয়ে আগ্রহী সেই ইংরেজ বালিকাটির কথা।
‘পূর্বে আমার বিশ্বাস ছিল, আমাদের বাংলা অক্ষর উচ্চারণে কোনও গোলযোগ নাই। কেবল তিনটে স, দুটো ন ও দুটো জ শিশুদিগকে বিপাকে ফেলিয়া থাকে। এই তিনটে স-এর হাত এড়াইবার জন্যই পরীক্ষার পূর্বে পণ্ডিতমহাশয় ছাত্রদিগকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ‘দেখো বাপু, সুশীতল সমীরণ লিখতে যদি ভাবনা উপস্থিত হয় তো লিখে দিও ঠান্ডা হাওয়া।’ এছাড়া দুটো ব-এর মধ্যে একটা ব কোনও কাজে লাগে না। ঋ ৯ ঙ ঞ-গুলো কেবল সং সাজিয়ে আছে। চেহারা দেখিলে হাসি আসে, কিন্তু মুখস্থ করিবার সময় শিশুদের বিপরীত ভাবোদয় হয়। সকলের চেয়ে কষ্ট দেয় দীর্ঘ-হ্রস্ব স্বর। কিন্তু বর্ণমালার মধ্যে যতই গোলযোগ থাক না কেন, আমাদের উচ্চারণের মধ্যে কোনও অনিয়ম নাই, এইরূপ আমার ধারণা ছিল।
ইংল্যান্ডে থাকিতে আমার একজন ইংরেজ বন্ধুকে বাংলা পড়াইবার সময় আমার চৈতন্য হইল, এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ সমূলক নয়।
এ বিষয়ে আলোচনা করিবার পূর্বে একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক। বাংলা দেশের নানাস্থানে নানা প্রকার উচ্চারণের ভঙ্গী আছে। কলিকাতা অঞ্চলের উচ্চারণকেই আদর্শ ধরিয়া লইতে হইবে। কারণ, কলিকাতা রাজধানী। কলিকাতা সমস্ত বঙ্গভূমির সংক্ষিপ্তসার।
হরি শব্দে আমরা হ যেরূপ উচ্চারণ করি, হর শব্দে হ সেরূপ উচ্চারণ করি না। দেখা শব্দের এ-কার একরূপ এবং দেখি শব্দের একার আর-একরূপ। পবন শব্দের প অকারান্ত, ব ওকারান্ত, ন হসন্ত শব্দ। শ্বাস শব্দের শ্ব-র উচ্চারণ বিশুদ্ধ শ-এর মতো, কিন্তু বিশ্বাস শব্দে শ্ব-এর উচ্চারণ শ্শ-এর ন্যায়। ‘ব্যয়’ লিখি কিন্তু পড়ি—ব্যায়। অথচ অব্যয় শব্দে ব্য-এর উচ্চারণ ব্ব-এর মতো। আমরা লিখি গর্দভ, পড়ি—গর্দোব। লিখি ‘সহ্য’, পড়ি সোজঝো। এমন কত লিখিব…
বাংলাভাষার এইরূপ উচ্চারণের বিশৃঙ্খলা যখন নজরে পড়িল, তখন আমার জানিতে কৌতূহল হইল, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা নিয়ম আছে কিনা! আমার কাছে তখন খান দুই বাংলা অভিধান ছিল। মনোযোগ দিয়া তাহা হইতে উদাহরণ সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। যখন আমার খাতায় অনেকগুলি উদাহরণ সঞ্চিত হইল, তখন তাহা হইতে একটা নিয়ম বাহির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম।’
রবীন্দ্রনাথের অভিধানচর্চার শুরু এই সময় থেকেই—ইংল্যান্ড। ধন্যবাদ সেই ইংরেজকন্যাটিকে, যার জন্য এই কাজে মন দিতে রবীন্দ্রনাথ উৎসাহিত হয়েছিলেন। হতে পারে আমরা এখন ব্যাকরণ অভিধান নিয়ে গুরুগম্ভীর ভাবনাচিন্তা করছি, কিন্তু তা বলে কি আমাদের জানতে কৌতূহল হবে না কে সেই তরুণী বঙ্গভাষানুরাগিণী বিদেশিনী বন্ধু যিনি কবির কাছে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন। কবি এই তরুণীটির পরিচয় ‘বালক’ পত্রিকায় দেননি, ‘শব্দতত্ত্ব’ বই হয়ে বেরোল যখন তখনও জানাননি। পাঠকদের শুধু, তাঁর ‘একজন ইংরেজ বন্ধুকে বাংলা পড়াইবার’ কথাটুকু উল্লেখ করেছিলেন। এই ‘বন্ধু’ যে একজন ইংরেজ ললনা তা রবীন্দ্রনাথ জানালেন আরও পরে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে ‘লোকেন পালিত’ অধ্যায়ে।
‘আমাদের (লোকেন-রবি) অন্যান্য আলোচনার মধ্যে বাংলা শব্দতত্ত্বের একটা আলোচনা ছিল। তাহার উৎপত্তির কারণটা এই। ডাক্তার স্কটের একটি কন্যা আমার কাছে বাংলা শিখিবার জন্য উৎসাহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাঁহাকে বাংলা বর্ণমালা শিখাইবার সময় গর্ব করিয়া বলিয়াছিলাম যে, আমাদের ভাষায় বানানের মধ্যে একটা ধর্মজ্ঞান আছে, পদে পদে নিয়ম লংঘন করাই তাহার নিয়ম নহে। তাঁহাকে জানাইয়াছিলাম, ইংরেজি বানানরীতির অসংযম নিতান্তই হাস্যকর, কেবল তাহা মুখস্থ করিয়া আমাদিগকে পরীক্ষা দিতে হয় বলিয়াই সেটা এমন শোকাবহ। কিন্তু আমার গর্ব টিকিল না। দেখিলাম, বাংলা বানানও বাঁধন মানে না, তাহা যে ক্ষণে ক্ষণে নিয়ম ডিঙাইয়া চলে অভ্যাসবশত এতদিন তাহা লক্ষ্য করি নাই। তখন এই নিয়ম-ব্যতিক্রমের একটা নিয়ম খুঁজিতে প্রবৃত্ত হইলাম। ইউনিভার্সিটির কলেজের লাইব্রেরিতে বসিয়া এই কাজ করিতাম। লোকেন এই বিষয়ে আমাকে যে সাহায্য করিত তাহাতে আমার বিস্ময় বোধ হইত।’
ডাক্তার স্কটের তিন কন্যার মধ্যে ছোট দুজনই ভারতবর্ষীয় এই তরুণ অতিথির প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। এই দুয়েরই একজন বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ করে কবির কাছে সেই বিদেশি ভাষা শিখতে যথেষ্ট মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্রীকে ভাষা শিক্ষাদানে কবি যে কিছুমাত্র ফাঁকি দেননি তা তাঁর সেই সময়কার পরিশ্রমসাধ্য হোমওয়ার্ক থেকেই সুস্পষ্ট ঠাহর হয়। বিলেতে যদি রবীন্দ্রনাথ আর কিছুদিন থাকতেন তো লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের লাইব্রেরি কক্ষে বসে ওই তরুণ বয়সেই তিনি একখানা বড়সড়ো বাংলা উচ্চারণকোষ প্রস্তুত করে ফেলতে পারতেন। তাহলে বাংলা অভিধান সংকলনের ইতিহাসেও তাঁর নামটি চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে থাকত।
পরবর্তীকালে এক আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ দিলীপকুমার রায়কে বলেছিলেন, ‘আমি বিলেতে প্রথমে যে ডাক্তার পরিবারে অতিথি হয়ে ছিলাম, তাঁর দুটি মেয়েই যে আমাকে ভালোবাসত একথা আজ আমার কাছে একটুও ঝাপসা নেই—কিন্তু তখন যদি ছাই সেকথা বিশ্বাস করবার এতটুকুও মরাল কারেজ থাকত।’
যাইহোক, পিতার নির্দেশে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই রবীন্দ্রনাথকে স্বদেশে ফিরে আসতে হয়। অসমাপ্ত থেকে যায় তাঁর বাংলা উচ্চারণ সংক্রান্ত অনুসন্ধানী গবেষণাও। অজস্র উদাহরণ সংগ্রহ করে খাতার পাতা ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বাংলা উচ্চারণের অনিয়মের মধ্যে নিয়ম আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। ‘এই সকল উদাহরণ এবং তাহার টীকায় রাশি রাশি কাগজ পুরিয়া গিয়াছিল।’
কিন্তু কাজ শেষ করার অবসর না পেয়েই ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসতে হল। সঙ্গে নিয়ে এলেন ‘ভগ্নহৃদয়’ পাণ্ডুলিপি।
বিলেতে যে কাজ অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসতে হয়েছিল, দেশে ফিরে সেই কাজে ক্রমে ক্রমে আবার হাত দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বালক’-এ যার সূচনা, বার্ধক্যেও তা থেকে তিনি সরে আসেননি।
বাংলা ভাষাতত্ত্বে রবীন্দ্রনাথকে সুনীতিকুমার ‘একজন পাইওনিয়র বা অগ্রণী পথিকৃৎ’ বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন। এবং শব্দতত্ত্বচর্চায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার অসামান্যতা সুনীতিকুমার তাঁর ওডিবিএল গ্রন্থের ভূমিকায় সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন।
‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে যে প্রথম বাঙালি মনীষী ভাষা সমস্যার দিকে চোখ ফিরিয়েছিলেন তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ। ভাষাতত্ত্বের অনুরাগীদের কাছে শ্লাঘার বিষয় এই যে, ইনি একদিকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি ও দ্রষ্টা। অন্যদিকে, একজন তীক্ষ্ণধী ভাষাতাত্ত্বিক, যিনি ভাষারহস্যের সত্য সন্ধানে প্রগাঢ় নিষ্ঠাবান এবং আধুনিক পাশ্চাত্য ভাষাতত্ত্ববিদগণের বিচারপদ্ধতি ও আবিষ্কারসমূহের গুণগ্রাহী। বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান, বাংলা ধ্বন্যাত্মক শব্দ, বাংলা বিশেষ্য পদ ও অন্যান্য বিষয়ের উপর রবীন্দ্রনাথের গবেষণা কয়েকটি প্রবন্ধের আকারে বাহির হয়।’
সুনীতিবাবুর এই বই প্রস্তুত করতে সময় লেগেছিল বারো বছর। অর্থাৎ ১৯১৪ সাল নাগাদ কাজ শুরু করেন। এরই পাঁচ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের ‘শব্দতত্ত্ব’ বই প্রকাশিত হয়েছে, যার রচনাগুলি তার পূর্বেই ‘বালক’ ‘সাধনা’ ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’য় মুদ্রিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। শুধু সুনীতিবাবুই নন, রবীন্দ্রনাথের শব্দতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধাদি পড়ে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলেন তিন বাংলা অভিধান প্রস্তুতকারক জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজশেখর বসু। বাংলা অভিধান শাখাটি আজ যে সমৃদ্ধ স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে প্রচ্ছন্নভাবে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি রবীন্দ্রনাথ।
কেবল শব্দাবলির সংকলন ও তার অর্থনিরূপণ অভিধানকর্তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। সুতরাং বাংলা ব্যাকরণে অপণ্ডিত কোনও ব্যক্তির পক্ষে বাংলা অভিধান প্রস্তুত করা অসম্ভব। ১৮৮৫ সালেই বাঙালি বিদ্বৎসমাজকে সতর্ক ও সচেতন করে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই। সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ নাম দেওয়া হয়। বাংলা ব্যাকরণের অভাব আছে, ইহা পূরণ করিবার জন্য ভাষাতত্ত্বানুরাগী লোকের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।’ আর এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ পথিকৃৎ হিসাবে যে শ্রম স্বীকার করেছেন তার কোনও তুলনা হয় না। কোনও একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য ‘দীনেশবাবুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, হ্যর্নলে সাহেবের গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ, কেলগ সাহেবের হিন্দি ব্যাকরণ, গ্রিয়র্সন সাহেবের মৈথিলী ব্যাকরণ এবং ডাক্তার ব্রাউনের আসামি ব্যাকরণ’ তিনি অবলম্বন করেছিলেন। ১৮৯৮ সালে লেখা প্রবন্ধটির নাম ‘বাংলা বহুবচন’।
সংস্কৃত ব্যাকরণবিধির শাসন থেকে বাংলা ব্যাকরণকে রবীন্দ্রনাথ মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই প্রাকৃত বাংলার প্রকৃতি সন্ধানে কবির তৎপরতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শুধু বাংলা বহুবচন নয়, সম্বন্ধ পদ, উপসর্গ, শব্দদ্বৈত, ধ্বন্যাত্মক শব্দ, কৃৎ এবং তদ্ধিত ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর গভীর অনুসন্ধানী গবেষণা ও তার তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা এই বিষয়ে আমাদের চিন্তার সরণিতে মৌলিক আলোকসম্পাত করেছে।
প্রতিশব্দ নির্মাণ ও সংকলনের কাজটিও রবীন্দ্রনাথের আরেক মস্ত আভিধানিক কীর্তি। ইদানীং সব বাংলা অভিধানের পরিশিষ্টে পারিভাষিক শব্দাবলি সংযোজিত হতে দেখি। ইংরেজি শব্দের বঙ্গানুবাদের এই কাজে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাই ছিল সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য। ১৯৩০ সালে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় তিনি ইংরেজি শব্দের বাংলা অনুবাদের এক সুদীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকার বাইরেও সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যজুড়ে বহু সংখ্যক ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এইসব প্রতিশব্দের অনেকগুলিই কবির নিজের সৃষ্টি। বানান নিয়েও রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল নিজে ভেবেছেন, অন্যকেও ভাবিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা পত্রিকায় কবি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং আলোচনা ও বাদ-প্রতিবাদ করেছেন।
সে যাইহোক, কবির বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক প্রীতির মূলে কিন্তু বসে আছেন সেই ইংরেজকন্যা।